শ্যামল রং, ১৪ আগস্ট, ২০২৪: পশ্চিমবঙ্গে নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে গণজাগরণ শুরু হয়েছে। আন্দোলনকারীরা রাতের শহরের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে 'রাত দখল'। এই আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে শুরু হয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মূলে রয়েছে সম্প্রতি কলকাতার এক হাসপাতালে সংঘটিত এক ডাক্তার মেয়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা। এই বর্বরতার পরিপ্রেক্ষিতে সারা রাজ্যজুড়ে ক্ষোভে ফুঁসছে মানুষ।
কলকাতার এই ভয়াবহ ঘটনাটি পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে তীব্রভাবে নাড়া দিয়েছে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং নারীর প্রতি সহিংসতা আজ বিশ্বব্যাপী এক চরম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারীদের উপর অত্যাচার, ধর্ষণ এবং খুন শুধুমাত্র রাতের বেলাতেই ঘটে না, দিনের আলোতেও এর কোনো অভাব নেই। রাতকে যেভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে 'পুরুষের সময়' বলে দখল করা হয়, দিনকেও সেভাবে নির্ভয়ে নারীদের জন্য নিরাপদ বলা যায় না। এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধেই আজ নারীরা সরব হয়েছেন।
এই আন্দোলনটি 'টেইক ব্যাক দ্য নাইট' আন্দোলনের আদর্শে অনুপ্রাণিত। ১৯৭০-এর দশকে আমেরিকায় নারীনির্যাতনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছিলেন নারীরা, তখন তাঁদের হাতে থাকা ব্যানারে লেখা ছিল ‘টেইক ব্যাক দ্য নাইট’। সেই ব্যানার আজকের দিনের পশ্চিমবঙ্গে এসে ‘রাত দখল’ নামে পরিণত হয়েছে। তবে এখানেই প্রশ্ন ওঠে, দিনে নারীদের জন্য কী হবে? দিন কি দখল হয়ে গেছে? নারী আন্দোলনের নেত্রীরা বলছেন, দিন-রাত কোনো সময়ই এখনও নারীদের জন্য সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ নয়। দিনে বা রাতে, যেকোনো সময়েই নারীরা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। কারণ, এই পৃথিবী এখনও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে রয়েছে, যা নারীদের সমান অধিকার দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
নারীরা বছরের পর বছর ধরে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছেন, কিন্তু তবুও এই পুরুষতন্ত্রের দাপট কমেনি। পুরুষতন্ত্রের অধীনে পুরুষের আধিপত্য, পেশির শক্তি, এবং পৌরুষের বিষাক্ত প্রভাব নারীদের উপর চাপিয়ে রাখা হয়। যতদিন পুরুষতন্ত্র টিকে থাকবে, ততদিন নারীরা দিন-রাত যে কোনো সময়ে শিকার হতে থাকবে। ‘রাত দখল’ আন্দোলন শুধু রাতের দাবি নয়, এটি নারী স্বাধীনতা ও সমতার লড়াই।
১৪ আগস্ট রাত এগারোটায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে নারীরা এবং তাঁদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা পুরুষরা জমায়েত হচ্ছেন। এর মূল উদ্দেশ্য হলো রাতের শহরকে পুনর্দখল করা, যা দীর্ঘদিন ধরে নারীদের জন্য ভয় ও আতঙ্কের স্থানে পরিণত হয়েছে।
আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন মোড়ে ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একত্রিত হয়ে মিছিল করছেন। বিভিন্ন জেলায় রাত দখল করার এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে।
কলকাতার প্রধান জমায়েত স্থানগুলি
কলকাতায় এই আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হল কলেজ স্ট্রিট, একাডেমী অফ ফাইন আর্টস, যাদবপুর, সিঁথির মোড়, ডানলপসহ আরও অনেক স্থান। এখানে মিছিলকারীরা একত্রিত হয়ে নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবেন। এছাড়াও উত্তরপাড়া, ব্যারাকপুর, বেহালা, ডোমজুরসহ আরও বিভিন্ন স্থানে মিছিল ও জমায়েতের আয়োজন করা হয়েছে।
রাজ্যের বিভিন্ন জেলা ও শহরে রাত দখল করার এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ জেলা শহরে, এমনকি কলকাতার বাইরে দার্জিলিং, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, পুরুলিয়া, দুর্গাপুর, আসানসোল, বালুরঘাট, শান্তিপুর, এবং রামপুরহাটসহ বিভিন্ন স্থানে মিছিল ও জমায়েতের আয়োজন করা হয়েছে।
কলেজ স্ট্রিট, একাডেমী অফ ফাইন আর্টস, যাদবপুর এইট বি, সিঁথির মোড়, ডানলপ (খালসা মডেল স্কুল যাবার গলি মোড়), নীলদর্পণ, বনগাঁ,বেহালা সখের বাজার, উত্তরপাড়া কলেজ মোড়, ডোমজুর, হাওড়া, হাওড়া ময়দান, সোদপুর বি.টি রোড ক্রসিং।
কলকাতার বাইরে, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, দক্ষিণ দিনাজপুরসহ অন্যান্য জেলার বিভিন্ন স্থানে মানুষ জমায়েত হচ্ছেন। এতে অংশগ্রহণকারী সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন রয়েছে।
মালদা ইংলিশ বাজার পোস্ট অফিস মোড়, শিলিগুড়ি দার্জিলিং মোড়, বাঁকুরা কৃষক বাজার,হলদিবাড়ি ট্রাফিক মোড়, আন্দুল বাসস্ট্যান্ড, মেদিনীপুর, পঞ্চুর চক, ইসলামপুর বাস টার্মিনাস, বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ড
এই আন্দোলনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক। বিভিন্ন স্তরের মানুষ, বিশেষত তরুণ সমাজ, এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছে। নারীরা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রাস্তায় নেমে এসেছে। তাদের দাবি, রাত শুধু পুরুষের নয়, নারীরাও রাস্তায় বের হবে নির্ভয়ে। এ আন্দোলন নারী পুরুষ সমান অধিকার ও সম্মানের দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে, যতদিন না সমাজে পুরুষতন্ত্রের অবসান ঘটে।
এই আন্দোলন যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে এটি পশ্চিমবঙ্গে নারী অধিকার আন্দোলনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। এক্ষেত্রে সমাজের সর্বস্তরের সমর্থন এবং অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। যতদিন পুরুষতন্ত্র টিকে থাকবে, ততদিন নারীর অধিকার ও সুরক্ষার জন্য সংগ্রাম চলবে। 'রাত দখল' শুধুমাত্র একটি রাতের আন্দোলন নয়, এটি পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক স্থায়ী লড়াই।