মনসুকা খবর, নিউজ ডেস্ক: পশ্চিমবঙ্গের সৈকত নগরী দীঘা আজ এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের দ্বারপ্রান্তে। অক্ষয় তৃতীয়ার শুভ লগ্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে উদ্বোধন হতে চলেছে জগন্নাথ মন্দির। পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরের আদলে নির্মিত এই মন্দির শুধুমাত্র ধর্মীয় কেন্দ্র নয়, বাংলার পর্যটন মানচিত্রে নতুন এক মাইলফলক হিসেবে উঠে আসবে। প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই মন্দির নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে উৎসাহ-উদ্দীপনা তুঙ্গে। আজ সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে।
২০১৮ সালে পূর্ব মেদিনীপুর সফরের সময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের ঘোষণা করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের মতো একটি আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা, যা ভক্তদের পাশাপাশি পর্যটকদেরও আকর্ষণ করবে। ২০১৯ সালে বিশদ প্রকল্প প্রতিবেদন (ডিপিআর) চূড়ান্ত হয়। ২০২২ সালের অক্ষয় তৃতীয়ায় নির্মাণ কাজ শুরু হয়, যদিও করোনা মহামারীর কারণে কিছুটা বিলম্ব হয়।
২৫ একর জমির উপর নির্মিত এই মন্দিরটি দীঘা রেল স্টেশনের কাছে নন্দকুমার-দীঘা ১১৬বি জাতীয় সড়কের পাশে অবস্থিত। মন্দিরের উচ্চতা ৬৫ মিটার (২১৩ ফুট), যা পুরীর মন্দিরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। রাজস্থানের বংশী পাহাড় থেকে আনা বেলেপাথর এবং ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা মার্বেল ফ্লোরিং এই মন্দিরের স্থাপত্যকে দিয়েছে এক অনন্য মহিমা।
দীঘার জগন্নাথ মন্দির পুরীর কলিঙ্গ স্থাপত্যশৈলীর একটি প্রতিচ্ছবি। মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার মূর্তি স্থাপিত হবে। এছাড়াও লক্ষ্মী, বিমলা, সত্যভামা প্রমুখ দেবদেবীর মূর্তি থাকবে। মন্দিরে চারটি প্রবেশদ্বার—হস্তীদ্বার, অশ্বদ্বার, সিংহদ্বার ও ব্যাঘ্রদ্বার—পুরীর মতোই নির্মিত। মূল মন্দির ছাড়াও ভোগমণ্ডপ, নাটমন্দির, জগমোহন এবং গর্ভগৃহ রয়েছে। নাটমন্দিরটি ১৬টি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে।
মন্দিরের একটি বিশেষ আকর্ষণ হবে ধ্বজা তোলার ব্যবস্থা। প্রতি সন্ধ্যায় পুরীর মতো এখানেও ধ্বজা তোলা হবে। রথযাত্রার জন্য তিনটি রথ নির্মাণের কাজ চলছে, এবং প্রতি বছর দীঘায় রথযাত্রা উৎসব পালিত হবে। মন্দির প্রাঙ্গণে সোনার ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কারের রীতিও পালিত হবে। এই উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ৫ লক্ষ ১ টাকা দান করেছেন।
আজ, ৩০ এপ্রিল, উদ্বোধন অনুষ্ঠান এক বিশাল আয়োজন হতে চলেছে। গত ২৮ এপ্রিল থেকে মুখ্যমন্ত্রী দীঘায় উপস্থিত রয়েছেন। ২৯ এপ্রিল থেকে মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে, এবং গতকাল মুখ্যমন্ত্রী নিজে যজ্ঞে পূর্ণাহুতি দিয়েছেন। আজ সকাল ১১টায় পুরীর রাজেশ দৈতাপতির তত্ত্বাবধানে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা ও সুদর্শনের মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হবে। বেলা আড়াইটায় সরকারি অনুষ্ঠান শুরু হবে, এবং ৩টায় মন্দিরের দ্বারোদঘাটন হবে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন রাজ্যের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, পুলক রায়, স্নোহাশিস চক্রবর্তী, সুজিত বসু প্রমুখ। তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, জুন মালিয়া, বিধায়ক সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং টলিউডের শ্রীকান্ত মোহতা, নচিকেতা, দেবলীনা কুমার, জিৎ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখও উপস্থিত থাকবেন।
মুখ্যমন্ত্রী এই উপলক্ষে ‘জয় জগন্নাথ ধাম’ নামে একটি গান লিখেছেন এবং সুর দিয়েছেন, যা গাইছেন রাজ্যের পর্যটন মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন। এই মিউজিক ভিডিওটি আজ মমতার ফেসবুক পেজে প্রকাশিত হবে।
দীঘার জগন্নাথ মন্দির শুধু ধর্মীয় গুরুত্বই বহন করবে না, রাজ্যের পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “এই মন্দির আধ্যাত্মবাদ ও সম্প্রীতির মিলন ঘটাবে। দীঘায় পর্যটকদের আনাগোনা বাড়বে।” পুরীতে সমুদ্র ও জগন্নাথ দর্শনের জন্য যেমন ভিড় হয়, তেমনই দীঘায় এখন সমুদ্রের সঙ্গে জগন্নাথ দর্শনের সুযোগ মিলবে। এতে স্থানীয় অর্থনীতি, বিশেষ করে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির ব্যবসা বৃদ্ধি পাবে।
মন্দির প্রাঙ্গণে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভোগে স্থানীয় মিষ্টির প্রাধান্য থাকবে, যা স্থানীয় উদ্যোগীদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে।
উদ্বোধন অনুষ্ঠান নির্বিঘ্ন করতে রাজ্য প্রশাসন ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। রাজ্যের ১২টি জেলা থেকে পুলিশ কর্মীদের নিয়োগ করা হয়েছে। মন্দিরের চারপাশে নিরাপত্তার কড়া ব্যবস্থা রয়েছে। ১১৬বি জাতীয় সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, এবং বিশেষ পার্কিং ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ, রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার সহ একাধিক শীর্ষ আধিকারিক ইতিমধ্যে দীঘায় পৌঁছে গিয়েছেন। প্রশাসনের লক্ষ্য ভিড় নিয়ন্ত্রণ এবং দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
মন্দির নির্মাণ নিয়ে কিছু বিতর্কও রয়েছে। বিজেপি নেতা অমিত মালব্য অভিযোগ করেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রকল্পের মাধ্যমে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ প্রমাণের চেষ্টা করছেন, এবং সরকারি নথিতে মন্দিরকে ‘সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, এটি রাজনৈতিক স্বার্থে করা হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী এই অভিযোগের জবাবে বলেছেন, “সমস্ত ধর্ম-বর্ণের মানুষ এখানে আসবেন। ধর্ম হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার জিনিস।” তিনি বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেন, “বুকের পাটা থাকলে এই মন্দির নির্মাণ আটকে দেখান।”
দীঘার জগন্নাথ মন্দির মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দূরদর্শী নেতৃত্বের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। এটি শুধু ধর্মীয় গুরুত্বই বহন করবে না, বাংলার সাংস্কৃতিক ও পর্যটন ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “মা-মাটি-মানুষ ভাল থাকলে আমি ভাল থাকব।” এই মন্দির হয়তো সেই দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রতীক। আজকের উদ্বোধনের পর দীঘার এই জগন্নাথ ধাম ভারতের অন্যতম তীর্থক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠবে বলে আশা করা যায়।