ঘাটালের বন্যা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত এবং একটি অসমাপ্ত মহাপরিকল্পনার বিশদ বিশ্লেষণ
রিপোর্ট, মনসুকা খবর, নিউজডেস্ক: পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমা শুধুমাত্র একটি ভৌগোলিক অঞ্চল নয়, এটি প্রতি বছর বর্ষায় ফিরে আসা এক মানবিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। এখানকার বন্যা কোনো আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং এটি একটি জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী সংকট, যার গভীরে প্রোথিত রয়েছে অঞ্চলের ভূসংস্থানিক বাস্তবতা, ঐতিহাসিক প্রকৌশলগত ভুলের উত্তরাধিকার এবং কয়েক দশক ধরে চলা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা। এই প্রতিবেদনটির মূল উদ্দেশ্য হলো ঘাটালের বার্ষিক বন্যাকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে না দেখে, এর সাথে জড়িত প্রতিটি কারণ—ভৌগোলিক, মানবসৃষ্ট, জলবায়ুগত এবং রাজনৈতিক—তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা।
এই প্রতিবেদনে প্রথমে ঘাটালের বন্যার প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণগুলো চিহ্নিত করা হবে। এরপর, এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হিসেবে বিবেচিত ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’-এর ছয় দশকের দীর্ঘ এবং জটিল ইতিহাস, এর উদ্দেশ্য ও বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা হবে। মহাপরিকল্পনাটিকে কেন্দ্র করে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে চলমান রাজনৈতিক সংঘাত, দোষারোপের সংস্কৃতি এবং এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে যে অপরিসীম দুর্ভোগ নেমে এসেছে, তার একটি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করা হবে। সবশেষে, শুধুমাত্র কাঠামোগত সমাধানের বাইরে গিয়ে একটি সামগ্রিক ও টেকসই বন্যা ব্যবস্থাপনার জন্য কিছু নীতিগত সুপারিশ করা হবে। এই প্রতিবেদনের লক্ষ্য হলো, ঘাটালের বন্যা সংকটকে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করা, যা নীতিনির্ধারক, গবেষক এবং সাধারণ মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে কাজ করতে পারে।
অধ্যায় ১: ঘাটালের বন্যার কারণ: প্রকৃতি ও মানুষের ভূমিকা
ঘাটালের বন্যা পরিস্থিতি কোনো একক কারণে সৃষ্ট নয়, বরং এটি প্রাকৃতিক দুর্বলতা এবং মানবসৃষ্ট ভুলের এক জটিল সংমিশ্রণ। এই অঞ্চলের ভৌগোলিক গঠন যেমন বন্যার জন্য সহায়ক, তেমনই কয়েক দশক ধরে চলা অপরিকল্পিত হস্তক্ষেপ এবং জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।
১.১ ভৌগোলিক অবস্থান এবং ভূসংস্থানিক বৈশিষ্ট্য
ঘাটালের বন্যাপ্রবণতার মূল কারণ এর ভৌগোলিক অবস্থান এবং ভূসংস্থান। ছোটনাগপুর মালভূমির পাদদেশে অবস্থিত এই অঞ্চলটি স্বাভাবিকভাবেই একটি নিম্নভূমি, যার গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৫ মিটার (১৬ ফুট) । এই অঞ্চলের ভূসংস্থান অনেকটা ‘বাটি-আকৃতির’ (basin-shaped), যা এটিকে একটি প্রাকৃতিক জল জমার ক্ষেত্রে পরিণত করেছে । বর্ষাকালে বা অতিরিক্ত জলপ্রবাহের সময় এই বাটি-আকৃতির ভূখণ্ডে জল জমে থাকে এবং সহজে নিষ্কাশিত হতে পারে না, যার ফলে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় ।
এই অঞ্চলটি শিলাবতী, দ্বারকেশ্বর, রূপনারায়ণ, কংসাবতী এবং তাদের অসংখ্য উপনদী ও শাখানদীর এক জটিল জালবিন্যাসে আবৃত । এই নদীগুলি মূলত বৃষ্টি-পুষ্ট এবং আংশিকভাবে নিয়ন্ত্রিত, যা বর্ষাকালে বিপুল পরিমাণ জল বহন করে। নদীগুলির নিম্ন অববাহিকায় ঢাল অত্যন্ত কম হওয়ায় জলের গতি মন্থর, যা জল নিষ্কাশনে প্রাকৃতিক বাধা সৃষ্টি করে এবং বন্যার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় ।
১.২ মানবসৃষ্ট কারণ এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
প্রাকৃতিক দুর্বলতার সাথে যুক্ত হয়েছে মানুষের অপরিকল্পিত কার্যকলাপ, যা ঘাটালের বন্যাকে এক বার্ষিক অভিশাপে পরিণত করেছে। এর শেকড় লুকিয়ে আছে ঔপনিবেশিক আমলের প্রকৌশলগত সিদ্ধান্তের মধ্যে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত ‘সার্কিট বাঁধ’ (circuit embankments) এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক জল নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে স্থায়ীভাবে ব্যাহত করেছে । নদীর স্বাভাবিক ঢাল এবং প্লাবনভূমির চরিত্রকে উপেক্ষা করে এই বাঁধগুলি তৈরি করার ফলে নদীর প্রবাহ সংকুচিত হয়ে পড়ে। এই ঐতিহাসিক ভুলটি একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার জন্ম দিয়েছে, যেখানে একটি প্রাথমিক ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ধারাবাহিক সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই বাঁধ এবং পরবর্তীকালে নির্মিত স্লুইস গেটগুলির কারণে নদীর পলি বহনের স্বাভাবিক ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। জোয়ারের সময় সমুদ্র থেকে আসা পলি নদীর মোহনার দিকে না গিয়ে বাঁধের কারণে নদীর ভিতরেই জমা হতে শুরু করে । বছরের পর বছর ধরে এই পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে, যা নদীর নাব্যতা এবং জলধারণ ক্ষমতাকে ভয়াবহভাবে কমিয়ে দিয়েছে । ফলস্বরূপ, এখন সাধারণ বর্ষার বৃষ্টিতেই নদীর জল উপচে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে।
১.৩ জলবায়ু পরিবর্তন এবং চরম আবহাওয়ার প্রভাব
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঘাটালের বন্যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বায়ুমণ্ডলের জলীয় বাষ্প ধারণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলস্বরূপ অল্প সময়ের মধ্যে অতি ভারী বর্ষণের (heavy downpour) ঘটনা বাড়ছে । আগে যেখানে বৃষ্টিপাত বেশ কয়েক দিন ধরে মাঝারিভাবে হতো, এখন সেখানে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিপুল পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে। এই ধরনের চরম আবহাওয়ার কারণে মাটি দ্রুত সম্পৃক্ত হয়ে যায় এবং অতিরিক্ত জল ধারণ করতে পারে না। ফলে, প্রায় সমস্ত জলই runoff হিসেবে দ্রুত নদীতে গিয়ে মেশে, যা আকস্মিক এবং ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে । জলবায়ু পরিবর্তন এখানে একটি ‘থ্রেট মাল্টিপ্লায়ার’ বা সংকট বিবর্ধক হিসেবে কাজ করছে, যা অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্বলতাকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
১.৪ ডিভিসি (DVC) এবং অন্যান্য জলাধার থেকে জল ছাড়ার ভূমিকা: একটি 'মনুষ্যসৃষ্ট বন্যা'
ঘাটালের বন্যা পরিস্থিতিকে তীব্রতর করার ক্ষেত্রে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (DVC) এবং কংসাবতী প্রকল্পের জলাধার থেকে জল ছাড়ার একটি বড় ভূমিকা রয়েছে । এটি প্রায়শই একটি ‘মনুষ্যসৃষ্ট বন্যা’ (man-made flood) হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, DVC এবং ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত অন্যান্য বাঁধগুলি, বিশেষ করে বর্ষাকালে, আগাম সঠিক তথ্য না দিয়ে বা অপরিকল্পিতভাবে বিপুল পরিমাণ জল ছাড়ে । যখন ঘাটাল অঞ্চলের নদীগুলি ইতিমধ্যেই স্থানীয় বৃষ্টিতে পূর্ণ থাকে, তখন জলাধার থেকে ছাড়া অতিরিক্ত জল পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায় এবং ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে ।
অন্যদিকে, DVC-এর দাবি, তারা দামোদর ভ্যালি রিজার্ভার রেগুলেশন কমিটি (DVRRC)-র নিয়ম এবং পরামর্শ মেনেই জল ছাড়ে, যে কমিটিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রতিনিধিও উপস্থিত থাকেন । DVC-এর মতে, তারা জলাধারগুলিতে আগত জলের একটি বড় অংশ ধরে রেখে বন্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং শুধুমাত্র বাঁধের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় জলই ছাড়া হয় । এই বিতর্কে আরও জটিলতা যোগ করেছে ঝাড়খণ্ড সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা তেনুঘাট বাঁধ, যা DVRRC-র আওতার বাইরে থেকে জল ছাড়ে এবং যা সমন্বয়হীনতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে ।
এই পারস্পরিক দোষারোপ প্রমাণ করে যে, ঘাটালের বন্যা শুধুমাত্র একটি স্থানীয় সমস্যা নয়, বরং এটি একটি আন্তঃরাজ্য এবং আন্তঃ-প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের ব্যর্থতার ফল। প্রাকৃতিক দুর্বলতা, ঐতিহাসিক ভুল এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে যখন এই প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা যুক্ত হয়, তখন ঘাটালের বন্যা একটি অদম্য সংকটে পরিণত হয়, যা প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে।
অধ্যায় ২: ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান - একটি ছয় দশকের প্রতীক্ষা
ঘাটালের মানুষের কাছে ‘মাস্টার প্ল্যান’ শব্দটি একই সাথে আশা এবং হতাশার প্রতীক। কয়েক দশক ধরে এই মহাপরিকল্পনাটিকে বন্যার অভিশাপ থেকে মুক্তির একমাত্র স্থায়ী সমাধান হিসেবে দেখা হলেও, এর বাস্তবায়ন দীর্ঘসূত্রিতা, প্রশাসনিক জটিলতা এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েনের এক জীবন্ত উদাহরণ হয়ে রয়েছে।
২.১ পরিকল্পনা, ইতিহাস এবং উদ্দেশ্য
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের ধারণাটি নতুন নয়। এই অঞ্চলের বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য ১৯৫৯ সালে মানসিংহ কমিটির রিপোর্টে প্রথম এই ধরনের একটি মহাপরিকল্পনার কথা ভাবা হয়েছিল । কিন্তু এর আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে সময় লেগে যায় আরও দুই দশকের বেশি, ১৯৮২ সালে । এই দীর্ঘ সময়ক্ষেপই প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ জটিলতার একটি পূর্বাভাস ছিল।
এই মহাপরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হলো, ঘাটাল মহকুমার অন্তর্গত পশ্চিম মেদিনীপুর এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বন্যা-প্রবণ এলাকাগুলিকে শিলাবতী, রূপনারায়ণ, কংসাবতী এবং অন্যান্য নদীর বিধ্বংসী বন্যা থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষা করা । এটি শুধুমাত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং এই অঞ্চলের কৃষি, অর্থনীতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার একটি বৃহত্তর প্রয়াস।
২.২ মহাপরিকল্পনার মূল কাঠামোগত উপাদান
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান একটি বহুমুখী এবং প্রযুক্তিগতভাবে জটিল প্রকল্প, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রধান কাঠামোগত উপাদান রয়েছে। এই উপাদানগুলি সম্মিলিতভাবে নদীগুলির জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ এবং অতিরিক্ত জল নিষ্কাশনের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা যার মূল উদ্দেশ্য হলো বন্যা নিয়ন্ত্রণ। এর পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। তবে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় আরও অনেক পরে, ১৯৮২ সালে।
২০১৭ সালের মূল্যস্তর অনুযায়ী, এই প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১,২৩৮.৯৫ কোটি টাকা। তবে, ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে রাজ্য সরকার এর জন্য ১,৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।
এই প্রকল্পের প্রধান কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে শিলাবতী ও কংসাই নদীর মতো গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর ড্রেজিং, নতুন বাঁধ ও গার্ড ওয়াল তৈরি, স্লুইস গেট এবং পাম্প হাউস নির্মাণ, এবং নদীগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা।
বর্তমানে, ২০২৫ সালের তথ্যানুসারে, রাজ্য সরকারের অর্থায়নে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। স্লুইস গেট নির্মাণের প্রায় ৬০-৭০% কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং খাল ড্রেজিং প্রায় শেষ। পাম্প হাউস ও নদী ড্রেজিং-এর জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছে। এই প্রকল্পের কাজ ২০২৭ বা ২০২৮ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
নদী ড্রেজিং (River Dredging): প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো নদীখাত থেকে পলি অপসারণ করে নদীর নাব্যতা এবং জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এর আওতায় রূপনারায়ণ, শিলাবতী, কংসাবতী সহ প্রায় ১০টি প্রধান নদীর ড্রেজিং করার কথা রয়েছে । সাম্প্রতিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, শুধুমাত্র শিলাবতী নদীতে ৮৬ কিমি এবং কংসাই (কংসাবতী) নদীতে ৪৮.৭০ কিমি ড্রেজিং-এর লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে ।
বাঁধ নির্মাণ ও শক্তিশালীকরণ (Embankment Construction and Strengthening): নদীর দুই তীরে existentes বাঁধগুলিকে আরও উঁচু ও শক্তিশালী করার পাশাপাশি নতুন বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে শিলাবতীর বাম তীরে ৩.৫ কিমি দীর্ঘ একটি কংক্রিটের রক্ষাপ্রাচীর বা ‘গার্ড ওয়াল’ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, যার জন্য আনুমানিক ₹65 কোটি টাকা ব্যয় হবে ।
স্লুইস গেট ও পাম্প হাউস (Sluice Gates and Pump Houses): নদীর জলপ্রবাহকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং নিম্নভূমি থেকে জমে থাকা জল বের করে দেওয়ার জন্য আধুনিক পরিকাঠামো তৈরি করা হবে। এর মধ্যে ৫টি নতুন স্লুইস গেট এবং ঘাটাল পৌরসভা এলাকায় ২টি শক্তিশালী পাম্প হাউস স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে ।
নদী আন্তঃসংযোগ (River Interlinking): এটি প্রকল্পের সবচেয়ে জটিল এবং महत्त्वाकांक्षी অংশ। এর মাধ্যমে একটি নদীর অতিরিক্ত জল খালের মাধ্যমে অন্য নদীতে চালিত করে বন্যার চাপ কমানোর চেষ্টা করা হবে ।
২.৩ বর্তমান অবস্থা এবং অগ্রগতি (২০২৫ সাল পর্যন্ত)
কয়েক দশকের অচলাবস্থার পর, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান অবশেষে বাস্তবায়নের পথে কিছুটা এগিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের দীর্ঘসূত্রিতা এবং অর্থায়নের অভাবে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে । রাজ্য সরকার এই প্রকল্পের জন্য মোট ₹১,৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে এবং ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের বাজেটে প্রাথমিক পর্যায়ে ₹৫০০ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে ।
এই অর্থায়নের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। পাঁচটি স্লুইস গেটের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে এবং ইতিমধ্যেই তার ৬০-৭০% সম্পন্ন হয়েছে। চন্দ্রেশ্বর খালের ড্রেজিং প্রায় সমাপ্ত। ঘাটাল পৌরসভা এলাকায় দুটি পাম্প হাউস নির্মাণের জন্য ওয়ার্ক অর্ডার জারি করা হয়েছে । এছাড়াও, শিলাবতী, পুরনো কংসাই, তমাল, পরাণ, বুড়িগঙ্গা সহ মোট প্রায় ৭৫ কিমি নদী ও খালের ড্রেজিং-এর জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে । সরকারের লক্ষ্য, মার্চ ২০২৭ বা ২০২৮ সালের মধ্যে এই বহুপ্রতীক্ষিত প্রকল্পটি সম্পন্ন করা ।
২.৪ সংশোধিত ব্লুপ্রিন্ট এবং জমি অধিগ্রহণের চ্যালেঞ্জ
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় এবং সংবেদনশীল বাধা হলো জমি অধিগ্রহণ । ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় নদী খনন, খাল কাটা এবং বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রচুর ব্যক্তিগত জমির প্রয়োজন, যা অধিগ্রহণ করা একটি সময়সাপেক্ষ এবং রাজনৈতিকভাবে জটিল প্রক্রিয়া । এই বাধা অতিক্রম করার জন্য রাজ্য সরকার একটি বাস্তবসম্মত কৌশল গ্রহণ করেছে। একটি সংশোধিত ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করা হচ্ছে, যার মূল লক্ষ্য হলো প্রকল্পের নকশার পরিবর্তন করে প্রয়োজনীয় জমির পরিমাণ প্রায় ৪০% কমিয়ে আনা । এটি শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়, বরং একটি কৌশলগত পদক্ষেপ, যা প্রকল্পের সবচেয়ে বড় বাধাটিকে এড়িয়ে গিয়ে দ্রুত বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত করার চেষ্টা করছে। এই পদক্ষেপটি প্রমাণ করে যে, দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা কাটিয়ে সরকার এখন একটি বাস্তবায়নযোগ্য সমাধানের দিকে মনোনিবেশ করেছে, যা প্রকল্পের সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যায় ৩: কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান শুধুমাত্র একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প নয়, এটি পশ্চিমবঙ্গ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যেকার রাজনৈতিক সংঘাত এবং দোষারোপের সংস্কৃতির এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দশকের পর দশক ধরে এই প্রকল্পটি অর্থায়ন এবং বাস্তবায়নের প্রশ্নে কেন্দ্র-রাজ্য বিতর্কের ঘূর্ণাবর্তে আটকে রয়েছে, যা ঘাটালের মানুষের দুর্ভোগকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
৩.১ অর্থায়ন নিয়ে টানাপোড়েন: একটি অমীমাংসিত বিতর্ক
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের দীর্ঘসূত্রিতার মূলে রয়েছে এর অর্থায়ন সংক্রান্ত জটিলতা এবং বিতর্ক। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৃণমূল কংগ্রেস বারবার অভিযোগ করেছে যে, ২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারকে একাধিকবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও এই প্রকল্পের জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি । রাজ্যের অভিযোগ, কেন্দ্র ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকল্পটিকে অবহেলা করেছে।
অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকারের জলশক্তি মন্ত্রকের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রকল্পটি ₹১,২৩৮.৯৫ কোটি টাকার টেকনো-ইকোনমিক অনুমোদন বা কারিগরি-অর্থনৈতিক ছাড়পত্র পেলেও, এটিকে কেন্দ্রের কোনো নির্দিষ্ট অর্থায়ন প্রকল্পের (funding scheme) আওতায় আনা হয়নি, যে কারণে কোনো তহবিল সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি । এটি একটি সূক্ষ্ম অথচ গুরুত্বপূর্ণ bureaucratic maneuver। এর মাধ্যমে কেন্দ্র প্রকল্পটিকে সরাসরি বাতিল না করেও, তহবিল আটকে রেখে এর বাস্তবায়নকে কার্যকরভাবে স্থগিত রেখেছে। এই পদ্ধতিটি রাজ্যকে রাজনৈতিকভাবে চাপে ফেলার একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যেখানে দায় রাজ্যের আর্থিক অক্ষমতার উপর চাপিয়ে দেওয়া যায়।
তহবিলের অনুপাত নিয়েও তীব্র মতবিরোধ রয়েছে। প্রথমে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে খরচের অনুপাত ৭৫:২৫ নির্ধারিত থাকলেও, পরবর্তীকালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার তা পরিবর্তন করে ৫০:৫০ করে দেয় । বিজেপির অভিযোগ, রাজ্য সরকার এই ৫০:৫০ অনুপাতে খরচ বহন করতে রাজি হয়নি এবং প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণেও ব্যর্থ হয়েছে, যা বিলম্বের মূল কারণ । এই পারস্পরিক দোষারোপের ফলে প্রকল্পটি বছরের পর বছর ধরে ফাইলবন্দী হয়ে ছিল।
এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার (তৃণমূল কংগ্রেস) এবং কেন্দ্রীয় সরকার (বিজেপি)-এর মধ্যে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। নিচে তা বিস্তারিতভাবে দেওয়া হলো:
অর্থায়ন
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবস্থান: তাদের অভিযোগ হলো, কেন্দ্র ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও কোনো তহবিল ছাড়েনি, যদিও প্রকল্পটি অনুমোদিত ছিল।
কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান: অন্যদিকে, কেন্দ্রের দাবি হলো, প্রকল্পটি কোনো কেন্দ্রীয় অর্থায়ন প্রকল্পের অধীনে অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তাই তহবিল দেওয়ার প্রশ্ন ওঠেনি। তাদের আরও অভিযোগ, রাজ্য সরকার ৫০:৫০ অনুপাতে খরচ বহন করতে রাজি হয়নি।
বাস্তবায়নে বিলম্ব
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবস্থান: তাদের মতে, এই বিলম্বের একমাত্র কারণ হলো কেন্দ্রের নিষ্ক্রিয়তা এবং তহবিলের অভাব।
কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান: কেন্দ্রের অভিযোগ হলো, রাজ্যের প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ করতে না পারার কারণেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে।
DVC-র জল ছাড়া
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবস্থান: রাজ্যের অভিযোগ হলো, DVC সঠিক সমন্বয় ছাড়াই জল ছেড়ে "মনুষ্যসৃষ্ট বন্যা" পরিস্থিতি তৈরি করে।
কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান: কেন্দ্রের দাবি হলো, DVC, DVRRC প্রোটোকল অনুযায়ী কাজ করে, যেখানে রাজ্যের প্রতিনিধিও উপস্থিত থাকে। তাদের মতে, DVC-র জল ছাড়া আসলে বন্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
৩.২ রাজনৈতিক দোষারোপের খেলা এবং জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানকে কেন্দ্র করে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে রাজনৈতিক দোষারোপের খেলা চরমে উঠেছে । এই প্রকল্পটি স্থানীয় এবং জাতীয় রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ঘাটালের তৃণমূল সাংসদ, অভিনেতা দীপক অধিকারী (দেব)-এর রাজনৈতিক পরিচিতি এবং সাফল্য এই মাস্টার প্ল্যানের প্রতিশ্রুতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি সংসদে বারবার এই বিষয়টি উত্থাপন করেছেন এবং প্রকল্পের বিলম্বের কারণে হতাশ হয়ে রাজনীতি ছাড়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন । তাঁর তারকাখ্যাতি এই সমস্যাটিকে জাতীয় স্তরে আলোচনায় নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। এক্ষেত্রে, ঘাটালের বন্যা সমস্যা এবং সাংসদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ একপ্রকার সহজীবী (symbiotic) সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই অমীমাংসিত সংকট তাঁকে প্রতি বছর একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ইস্যু প্রদান করে, এবং তাঁর তারকাখ্যাতি সেই ইস্যুটিকে জিইয়ে রাখে।
অন্যদিকে, বিজেপি নেতারা, বিশেষ করে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং প্রাক্তন সাংসদ লকেট চ্যাটার্জী, এই প্রকল্পের ব্যর্থতার জন্য রাজ্য সরকারের সদিচ্ছার অভাব, অদক্ষতা এবং জমি অধিগ্রহণে ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন । তাঁদের মতে, রাজ্য সরকার নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে শুধুমাত্র কেন্দ্রের উপর দোষ চাপাচ্ছে। এই রাজনৈতিক সংঘাতের ফলে ঘাটালের সাধারণ মানুষ দশকের পর দশক ধরে সমাধানের আশায় দিন গুনছে, কিন্তু বাস্তবায়ন আটকে থাকছে রাজনৈতিক গোলকধাঁধায়। অবশেষে, রাজ্য সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এই রাজনৈতিক অচলাবস্থা ভাঙার একটি প্রচেষ্টা করেছে, যা পুরো বিতর্কের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে এবং দায়বদ্ধতার প্রশ্নটিকে সরাসরি রাজ্য সরকারের কাঁধে নিয়ে এসেছে।
অধ্যায় ৪: বন্যার সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব এবং সাধারণ মানুষের আর্তি
ঘাটালের বন্যা শুধুমাত্র একটি ঋতুকালীন জলমগ্নতার ঘটনা নয়, এটি একটি বার্ষিক মানবিক বিপর্যয় যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন, জীবিকা এবং স্বপ্নকে ধ্বংস করে দেয়। প্রতি বছর বন্যার জল নেমে যাওয়ার পর রেখে যায় এক গভীর ক্ষত, যা শুকানোর আগেই পরের বছরের বন্যা এসে হাজির হয়।
৪.১ জীবন ও জীবিকার উপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব
বন্যার সবচেয়ে বিধ্বংসী প্রভাব পড়ে এই অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির উপর। ঘাটাল মূলত একটি কৃষিপ্রধান এলাকা, এবং বন্যা এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকাকে ধ্বংস করে দেয়।
কৃষি ও পশুপালন: প্রতি বছর হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি, বিশেষ করে ধান, পাট এবং সবজির ক্ষেত, দীর্ঘ সময় ধরে জলের তলায় থাকায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় । কৃষকদের সারা বছরের পরিশ্রম এবং বিনিয়োগ এক নিমেষে ভেসে যায়। শুধু ফসলই নয়, বন্যার জলে ভেসে গিয়ে বা খাদ্যাভাবে বহু গবাদি পশুও মারা যায়, যা গ্রামীণ পরিবারগুলির জন্য একটি বিরাট আর্থিক ক্ষতি ।
বাসস্থান ও সম্পত্তি: বন্যার করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পায় না মানুষের আশ্রয়স্থলও। গ্রামের মাটির বাড়িগুলি বন্যার তোড়ে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে এবং এমনকি পাকা বাড়িগুলিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । ২০১৭ সালের একটি ভয়াবহ বন্যায় প্রায় ২১,১৭৮টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যা এই সংকটের ভয়াবহতার একটি খণ্ডচিত্র মাত্র । বন্যার জল নেমে যাওয়ার পর ঘরবাড়ি মেরামত করা এবং স্বাভাবিক জীবনে ফেরা এক বিরাট সংগ্রামের সামিল।
অর্থনৈতিক কার্যকলাপ: বন্যা চলাকালীন রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় এবং বাজারগুলি জলমগ্ন হওয়ায় সমস্ত বাণিজ্যিক কার্যকলাপ স্তব্ধ হয়ে যায় । পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ফলে কৃষিপণ্য বাজারে পৌঁছাতে পারে না, এবং দিনমজুর ও ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের আয়ের উৎস হারায়। এই অর্থনৈতিক স্থবিরতা পুরো অঞ্চলের উন্নয়নকে দশকের পর দশক ধরে পিছিয়ে রেখেছে। এই বার্ষিক ক্ষয়ক্ষতির চক্র পরিবারগুলিকে সঞ্চয় করতে দেয় না এবং তাদের দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আটকে রাখে, যা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে স্থায়ীভাবে দমন করে রেখেছে।
৪.২ স্বাস্থ্য ও পরিকাঠামোর সংকট
বন্যার প্রভাব শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি জনস্বাস্থ্য এবং মৌলিক পরিকাঠামোর উপরও এক বিরাট সংকট তৈরি করে।
জনস্বাস্থ্য: বন্যার সময় এবং পরে দূষিত জলের কারণে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েডের মতো জলবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে । চারিদিকে জল জমে থাকায় মশার উপদ্রব বাড়ে এবং ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগ ছড়িয়ে পড়ে। বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব এই সংকটকে আরও তীব্র করে তোলে। এছাড়া, জলমগ্ন এলাকায় সাপের উপদ্রব বাড়ে এবং প্রতি বছর সর্পদংশনে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ।
পরিকাঠামো: বন্যার জলে রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট ভেসে যায়, যা পুরো এলাকাকে কার্যত বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করে । বিদ্যুৎ এবং টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, যা উদ্ধারकार्य এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করে। এলাকার স্কুলবাড়িগুলি ত্রাণ শিবিরে পরিণত হওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা দীর্ঘদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়, যা তাদের ভবিষ্যতের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে ।
৪.৩ স্থানীয় মানুষের অভিযোজন এবং একমাত্র দাবি
দশকের পর দশক ধরে এই বিপর্যয়ের সাথে বসবাস করতে করতে ঘাটালের মানুষ এক প্রকার ‘বাধ্যতামূলক সহনশীলতা’ (forced resilience) অর্জন করেছে। এটি প্রকৃত অর্থে কোনো ইতিবাচক অভিযোজন নয়, বরং একটি স্থায়ীভাবে ভেঙে পড়া ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নেওয়ার করুণ প্রচেষ্টা। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে একটি নৌকা রাখা হয়, যা তাদের কাছে দৈনন্দিন প্রয়োজনে ব্যবহৃত একটি মোটরবাইকের মতোই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে । বন্যার হাত থেকে বাঁচতে অনেকে তাদের বাড়িঘর উঁচু স্তম্ভের উপর তৈরি করতে বাধ্য হয়েছেন ।
এই সমস্ত অভিযোজন এবং অস্থায়ী ত্রাণ সত্ত্বেও, ঘাটালের মানুষের দাবি একটাই—একটি স্থায়ী সমাধান। তারা আর ত্রাণ বা ক্ষতিপূরণের উপর নির্ভর করে বাঁচতে চায় না। তাদের বহু দশকের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবং আর্তি একটাই প্রকল্পকে ঘিরে—ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের দ্রুত এবং সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন । তাদের কাছে এটি শুধুমাত্র একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প নয়, এটি তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুরক্ষিত এবং স্থিতিশীল জীবনের একমাত্র আশা।
অধ্যায় ৫: বিকল্প কৌশল এবং নীতিগত সুপারিশ
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিঃসন্দেহে এই অঞ্চলের বন্যা সমস্যার সমাধানের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তবে, শুধুমাত্র একটি কাঠামোগত প্রকল্পের উপর নির্ভর করা একটি আধুনিক এবং কার্যকর বন্যা ব্যবস্থাপনার জন্য যথেষ্ট নয়। একটি সামগ্রিক এবং টেকসই সমাধানের জন্য কাঠামোগত পদক্ষেপের পাশাপাশি অ-কাঠামোগত ব্যবস্থা এবং নীতিগত সংস্কার অপরিহার্য।
৫.১ অ-কাঠামোগত পদক্ষেপের গুরুত্ব
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান হলো একটি ‘হার্ডওয়্যার’ বা কাঠামোগত সমাধান। কিন্তু এর কার্যকারিতা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে যদি এর সাথে ‘সফটওয়্যার’ বা অ-কাঠামোগত পদক্ষেপগুলিকে যুক্ত করা হয়। ভারতের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (CAG)-এর একটি রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার বন্যা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ‘ফ্লাড প্লেইন জোনিং’ (Flood Plain Zoning) এবং ‘ফ্লাড প্রুফিং’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ অ-কাঠামোগত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে । এই ব্যর্থতা একটি বড় নীতিগত শূন্যতাকে নির্দেশ করে।
বন্যা পূর্বাভাস এবং সতর্কীকরণ ব্যবস্থা: আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি উন্নত এবং স্থানীয় স্তরে কার্যকর বন্যা পূর্বাভাস ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে মানুষকে সময়মতো নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে, যা জীবন ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারে ।
ফ্লাড প্লেইন জোনিং: নদীর প্লাবনভূমিকে বিভিন্ন ঝুঁকি অঞ্চলে ভাগ করে ভূমি ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা উচিত। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে নতুন নির্মাণ কাজ নিষিদ্ধ করা এবং কৃষি বা বিনোদনের মতো কাজের জন্য জমি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এটি ভবিষ্যতে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনাকে গোড়া থেকেই কমিয়ে দেবে ।
কমিউনিটি ভিত্তিক দুর্যোগ প্রস্তুতি: স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বন্যা মোকাবিলার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া, ত্রাণ ও উদ্ধার কাজের জন্য স্থানীয় দল গঠন করা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। স্থানীয় জ্ঞান এবং অংশগ্রহণ যে কোনো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনাকে আরও কার্যকর করে তোলে ।
এই অ-কাঠামোগত পদক্ষেপগুলি মাস্টার প্ল্যানের পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির মুখে অঞ্চলটিকে আরও সহনশীল করে তুলবে।
৫.২ সমন্বিত অববাহিকা ব্যবস্থাপনা এবং আন্তঃরাজ্য সমন্বয়
DVC-র জল ছাড়া নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য বিতর্ক প্রমাণ করে যে, ঘাটালের বন্যা সমস্যা শুধুমাত্র ঘাটালের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি বৃহত্তর নদী অববাহিকার সমস্যা। তাই, একটি বিচ্ছিন্ন প্রকল্পের পরিবর্তে একটি সমন্বিত নদী অববাহিকা ব্যবস্থাপনা (Integrated Basin Management) গ্রহণ করা অপরিহার্য ।
এর জন্য পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড এবং DVC-র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির মধ্যে একটি শক্তিশালী এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত সমন্বয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। দামোদর ভ্যালি রিজার্ভার রেগুলেশন কমিটি (DVRRC)-র কার্যকারিতা এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, ঝাড়খণ্ডের নিয়ন্ত্রণে থাকা তেনুঘাট বাঁধকেও এই সমন্বিত ব্যবস্থাপনার আওতায় আনার জন্য পুনরায় আলোচনা শুরু করা উচিত, যাতে সম্পূর্ণ অববাহিকার জলপ্রবাহকে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় ।
৫.৩ নীতিগত সুপারিশ
উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে, ঘাটালের বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত নীতিগত সুপারিশগুলি বিবেচনা করা যেতে পারে:
রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসন: কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে একটি উচ্চ-পর্যায়ের রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের অর্থায়ন এবং বাস্তবায়নের একটি সুস্পষ্ট, সময়বদ্ধ এবং দায়বদ্ধ কাঠামো তৈরি করতে হবে। দোষারোপের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করা অপরিহার্য।
স্বচ্ছ এবং ন্যায্য জমি অধিগ্রহণ: প্রকল্পের সংশোধিত ব্লুপ্রিন্ট দ্রুত চূড়ান্ত করে, স্থানীয় মানুষের সাথে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ এবং ন্যায্য ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ তৈরি করতে হবে। জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াটিকে দ্রুত এবং সংঘাতহীনভাবে সম্পন্ন করা প্রকল্পের সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি।
কমিউনিটির অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ: প্রকল্পের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণের প্রতিটি পর্যায়ে স্থানীয় মানুষের মতামত, অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে । এটি শুধুমাত্র প্রকল্পটিকে আরও কার্যকর করবে না, বরং এর প্রতি স্থানীয় মানুষের মালিকানাবোধও তৈরি করবে, যা দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের জন্য অপরিহার্য।
ঘাটালের বার্ষিক বন্যা নিছক একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়; এটি একটি বহুমাত্রিক সংকট যা প্রাকৃতিক দুর্বলতা, ঐতিহাসিক ভুল, প্রশাসনিক উদাসীনতা এবং দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সংঘাতের সম্মিলিত ফল। এই অঞ্চলের বাটি-আকৃতির ভূসংস্থান এবং জটিল নদী ব্যবস্থা বন্যার একটি প্রাকৃতিক ভিত্তি তৈরি করে, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ এবং তার ফলস্বরূপ নদীর নাব্যতা হ্রাস এই সমস্যাকে ভয়াবহ রূপ দিয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট চরম আবহাওয়া এবং DVC-র মতো সংস্থাগুলির সাথে সমন্বয়হীনতা, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
এই সংকটের স্থায়ী সমাধান হিসেবে বিবেচিত ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ নিজেই একটি ছয় দশকের দীর্ঘ প্রতীক্ষার গল্প। অর্থায়ন এবং বাস্তবায়নের প্রশ্নে কেন্দ্র-রাজ্য রাজনৈতিক টানাপোড়েনে এই প্রকল্পটি দশকের পর দশক ধরে আটকে ছিল, যা ঘাটালের মানুষের দুর্ভোগকে দীর্ঘায়িত করেছে। অবশেষে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়া নিঃসন্দেহে একটি আশার আলো। এটি প্রমাণ করে যে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থাও ভাঙা সম্ভব।
তবে, ভবিষ্যতের পথটি সহজ নয়। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের সাফল্য শুধুমাত্র প্রকৌশলগত দক্ষতা বা আর্থিক বরাদ্দের উপর নির্ভর করে না। এর সাফল্য নির্ভর করবে একটি সামগ্রিক দৃষ্টি কোনের উপর, যেখানে কাঠামোগত সমাধানের পাশাপাশি ফ্লাড প্লেইন জোনিং-এর মতো অ-কাঠামোগত ব্যবস্থা, আন্তঃরাজ্য সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি সমন্বিত অববাহিকা ব্যবস্থাপনা এবং স্থানীয় মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। ঘাটালের মানুষের ছয় দশকের প্রতীক্ষার অবসান ঘটাতে হলে শুধুমাত্র নদী খনন বা বাঁধ নির্মাণই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন শাসনব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা এবং সহযোগিতার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করা।
Comments
Post a Comment