জলের আর এক নাম জীবন , এই কথাটি বাল্যকাল থেকেই মুখস্ত । তবে প্রাথমিক শিক্ষায় জলের অপর নাম যে জীবন তা খুব বেশি বুঝতে না পারলেও পরবর্তী কালে শিক্ষার বিস্তারের সাথে সাথে তা বেশ ভালই বুঝতে পেরেছি ।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে যেখানে বিজ্ঞান এত বেশি উন্নত , বিজ্ঞানের সীমানার মধ্যে অধরা আর কোন কিছু নেই বললেই চলে অথচ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অগণিত গ্রহ- উপগ্রহের মধ্যে পৃথিবী ছাড়া জলের অস্তিত্ব আর অন্য কোন স্থানে অনুসন্ধান করা যাচ্ছে না । আমাদের এই স্বপ্নের পৃথিবী তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল নিয়ে গঠিত। এই তিন ভাগ জলকে একত্রে বলা হয় বারিমন্ডল বা হাইড্রোস্ফিয়ার , এর প্রধান উপাদান হল দুটি হাইড্রোজেন অণু ও একটি অক্সিজেন অণুর রাসায়নিক যৌগ । এই তিন ভাগ জল বা সমগ্র বারিমন্ডলকে যদি আমরা ১০০% জল ধরি তাহলে দেখবো ।
ক । সমুদ্রে লবনাক্ত অবস্থায় -- ৯৬ . ৫ %
খ । তুষারে কঠিন অবস্থায় --- ১. ৭ %
গ । ভূগর্ভে ভৌম অবস্থায় --- ১.৭ %
ঘ । পুকুর ডোবায় -- ০.১ %
অর্থাৎ মোট জলরাশির ৩.৫% জলকে নিয়েই এই সমগ্র পৃথিবীর বেঁচে থাকা । NITI Aayog রিপোর্ট অনুযায়ী সমগ্র পৃথিবীর ভূগর্ভস্থ জলের প্রায় ৪০% জল আমরা ব্যবহার করি অর্থাৎ আমাদের ভারতবর্ষের মানুষ ব্যবহার করে । খনিজ তেল , কয়লা , আকরিক লোহা, সোনা ,তামা, অভ্র ইত্যাদি সব প্রয়োজনীয় পদার্থ ভূগর্ভ থেকে তুলার ফলে প্রকৃতিক সম্পদের ভান্ডার যেমন ভাবে শেষ হচ্ছে , ঠিক অনুরূপ ভাবে ভুগর্ভস্থ ভৌমজল ( ground water ) মাত্রাতিরিক্ত ভাবে উত্তোলন ও পরিকল্পনাহীন ভাবে ব্যাবহার করতে করতে অনান্য প্রকৃতিক উপাদানের মতই ভূগর্ভস্থ প্রকৃতিক সম্পদ জল শেষ হয়ে আসছে ।
আমাদের আলোচনার বিষয় এই পরিস্থিতিতে ভারতবর্ষের অবস্থা কোথায় ? সম্প্রতি দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের চেন্নাইয়ের জল সঙ্কটের কারণে আমরা আমাদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্যমুলক আলোচনা করতে গিয়ে, আমাদের অবস্থান কিছুটা উপলব্ধি করতে পারছি ।
দক্ষিণ ভারতের পূর্বঘাট পর্বতমালার , মৌসুমীবায়ু প্রভাবিত করমন্ডল উপকুলের বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী আধুনিক সভ্যতায় সভ্য একটি মেগা শহর চেন্নাই । এই চেন্নাইয়ে তীব্র জল সংকট চলছে । শহর সংলগ্ন চারটি জলধারা শুকিয়ে গিয়েছে , এই সব জলধারা গুলিতে ১৫ সয়েল ওয়াটার ট্যাসিবল ইউনিট (S W T U ) থেকেও কম যেমন ( ১ ) ভেলাচেরি ১৩% (২) নোচিকুপ্পাম ৯% (৩) কাশিমেডু ৯% (৪) অযোধ্যাকুপন ৭% জল আছে অর্থাৎ যে পরিমাণ জল ধারন ক্ষমতা তার থেকে প্রায় কম বেশী ৯০% জল কম । এই পরিস্থিতিতে নদী - নালা , পুকুর- ডোবা, কুয়া সহ ক্যানেল গুলি শুকিয়ে গিয়েছে । ভূগর্ভস্থ জলস্তর মাত্রাতিরিক্ত ভাবে নেমে যাওয়ার ফলস্বরূপ কুঁয়ো শুকিয়ে গিয়েছে , নলকূপ গুলি থেকে জল পড়ছে না । আকাশে বৃষ্টির সেভাবে দেখা নেই , তার পরেও ছিটেফোঁটা যেটুকু বৃষ্টি হচ্ছে তাতে জীবন যাইযাই পরিস্থিতিতে কোন কাজেই আসছে না ।
এমতাবস্থায় জলের জন্য মানুষের মধ্যে নেমে এসেছে হাহাকার , এক লিটার জল যেখানে ২০ টাকা দাম চেন্নাইয়ে সেখানে ৩০০ টাকা থেকে ৩৫০টাকায় বিক্রি হচ্ছে । সরকারি ভাবে দৈনন্দিন জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় জল বিতরনের জন্য রাস্তা ধারের ট্যাপ গুলিতে রাত ৩ টে থেকেই একপাত্র পানীয় জলের জন্য সারিসারি জলপাত্রের কিলোমিটারের পর কিলোমিটার লম্বা লাইন । বাড়ির মহিলারা মাইলের পর মাইল হাঁটছে জলে জন্য । সরকারি ভাবে ও বেসরকারি ভাবে টাঙ্কারে করে জল সরবরাহ করে কোন রকমে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে । নর্দমার জল ফিল্টার করে অনেকেই ব্যবহার করছে । অফিসে অফিসে হাজিরায় কোন বাধ্যবাধকতা নেই । জলের অভাবে হোটেল বুকিং বন্ধ হয়ে গিয়েছে বললেই চলে ।
এমতাবস্থায় NITI Aayog রিপোর্ট বলছে যেভাবে জলস্তর মাত্রাতিরিক্ত ভাবে নেমে যাচ্ছে, যেভাবে ভূগর্ভস্থ জল শেষ হয়ে যাচ্ছে তাতে করে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২০ সালেই দিল্লি , চেন্নাই , বেঙ্গালুরু ও হায়দ্রাবাদের মত ভারতবর্ষের চারটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের ভূগর্ভস্থ জল ফুরিয়ে যাবে । এবং ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের স্বপ্নের ভারতবর্ষের ৪০% অর্থাৎ ৪৫ থেকে ৫০ কোটি মানুষের জীবনে জল হাহাকারের ক্ররালগ্রাস নেমে আসবে । আর তার থেকে রেহাই পাবে না আমাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ বঙ্গের জেলা ও শহর গুলিও ।
----- রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের রাজ্যের মোট ৩৪১ টি ব্লকের মধ্যে ৫০ টি ব্লকের অবস্থা উদ্বেগজনক । ২০১৯ চলতি বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২৪ পরগনা , হাওড়া , হুগলি , নদীয়া সহ বেশ কিছু জেলার জলস্তর গ্রীষ্মকালে ১৭-১৮ মিটার নিচে চলে যাচ্ছে , এবং বর্ষাকালে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪-৬ মিটার নিচে ছিল । এবং পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর , ঝাড়গ্রাম , বাঁকুড়া , পুরুলিয়া , বীরভূমের গ্রীষ্মকালীন ভূগর্ভস্থ জলস্তর ১৩ মিটার নিচে নেমে গিয়েছিল , ও বর্ষাকালে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৬ মিটার নিচে নেমে গিয়েছিল । তাই এই যদি পরিসংখ্যান হয় তাহলে আগামী দিনে চেন্নাইয়ের মত জল সংকট আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গের মানুষকেও দেখতে হতে পারে এবং তীব্র জল সংকটের বলি হলে অবাক হবার কিছু থাকবে না ।
এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে জল সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের সচেতন হবার সময় এসেছে । যদি আমাদের সচেতনতার সাথে এই জল সংকট মোকাবিলা করতে হয় তাহলে জানতে হবে জল সংকট কেন হয় ? এবং তার প্রতিকার । প্রথমে আমরা জল সংকটের প্রধান প্রধান কারণ গুলি নীতিআলোকপাত করবো ।
প্রথমতঃ মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে তাল মিলিয়ে পৃথিবীর বুক থেকে গাছ কাটা হচ্ছে । অথচ পুনরায় গাছ রোপণ করা হচ্ছে না , ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ন সমগ্র পৃথিবীটাকে গ্রাস করে নিচ্ছে । তার পরেও এই পৃথিবীর সমস্ত মন্দকে পরিচালিত করে বিশ্ব উষ্ণায়ন । আর এই উষ্ণ শুষ্ক পরিবেশ পৃথিবীর আদ্রতাকে শুকিয়ে দিচ্ছে । যা এই গাছ কাটা প্রধান কারণ ।
দ্বিতীয়তঃ অপরিকল্পিত ভাবে গাছ কাটার ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে , তার ফলে আগের মতো আর চলচক্রের ( Hydrological Cycle ) দ্বারা বৃষ্টিপাত প্রক্রিয়া সঠিক ভাবে সুসম্পন্ন হচ্ছে না অর্থাৎ বাষ্পীভবন বা Evaporation > ঘনীভবন বা Condensation > অধঃক্ষেপন বা বর্ষন বা Precipitation । ফলস্বরূপ গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে ।
তৃতীয়তঃ জলচক্রের মাধ্যমে নদী -নালা , খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হ্রদ বা জলধারার মধ্যে দিয়ে যে জল ভূগর্ভে প্রবেশ করে ,তা আর তেমন সহজ পদ্ধতিতে প্রবেশ করতে পারছে না । তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে মাটির নিচে জল কুপরিবাহি একটি প্লাস্টিকের স্তর সৃষ্টি হয়েছে । যার ফলে বৃষ্টির জল মাটির নিচে একটি নির্দিষ্ট পরিমাপের বেশী যেতে পারছে না ।
চতুর্থতঃ কৃষিকাজ , মাছচাষ, শিল্প , পানীয় ও দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ জল যত্রতত্র তোলা হচ্ছে । এবং সে জলের সঠিক ব্যবহার করা হচ্ছে না । চাষবাস, কল- কারখানা যে পরিমাণে জলের প্রয়োজন তার থেকে অনেক বেশী উত্তোলন হচ্ছে এবং অতিরিক্ত জল ক্যানেলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে সমুদ্রে পড়ছে , একদা ভূগর্ভস্থ মিষ্টি জল সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCI) মিশ্রিত নোনা জলের সাথে মিসে লবনাক্ত জলে রুপান্তরিত হচ্ছে ।
এই ভাবে চলতে থাকলে উপকুলীয় এলাকা গুলিতে ভূগর্ভে শূন্যস্থান সৃষ্টি হবে , আর সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে সমুদ্রের নোনা জল ছুটি আসবে , ফলে ভূগর্ভ মিষ্টি ভৌম জলের পরিবর্তে নোনা ভৌমজল উঠবে । চাষবাসের অকল্পনীয় ক্ষতি হবে , চাষের জমিতে নুনের পরিমাণ বেড়ে যাবে । সমুদ্রের তীরবর্তী এলাকায় আগের থেকে অনেক বেশি ভুমিক্ষয় সংগঠিত হবে ।
আমাদের যদি জল সংকটের মোকাবিলা করতে হবে । আর তার জন্য আমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে ।
১ । যত্রতত্র গাছ কাটা চলবে না , দেশে আইন করে গাছ কাটা দন্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করতে হবে । এবং এই আইন কে কার্যকরী করতে কমেটি তৈরি করতে হবে ।
২ । প্লাস্টিকের ব্যাবহার সম্পুর্ণ রুপে নিষিদ্ধ করতে হবে । এবং প্লাস্টিক ব্যবহার অপরাধ যোগ্য বলে আইন করতে হবে ।
৩ । যত বেশি পরিমাণে সম্ভব ড্রাম তৈরি করে পাহাড়ের কোলে বা , নদী -নালায় বৃষ্টির জলকে বাঁধ দিয়ে যতটা সম্ভব আটকে রাখতে হবে । অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে সৃষ্টি হওয়া বন্যায় জলকে ক্যানেলের মাধ্যমে অন্যত্রে পৌচ্ছানোর ব্যাবস্থা করতে হবে । এবং সেই জলকে মাছ চাষ , চাষবাস , এমনি পরিশোধন করে পানীয় জল হিসাবে ব্যবহার করতে হবে । তাতে ভূগর্ভস্থ ভৌম জলের বাড়বে সাথে সাথে রক্ষাও পাবে ।
৪ । বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সমুদ্রের নোনা জলকে ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে হবে । জলের বোতল তৈরি বহুজাতিক কোম্পানি গুলিকে সমুদ্রের জল ফিল্টারিং করার জন্য যে বাধ্য হয় তার জন্য আইন তৈরি করতে হবে ।
৫ । পানীয় জলের অপব্যবহার রোধ করতে সকলকেই এগিয়ে আসছে হবে । সাধারণত দেখা যায় সরকারি ভাবে শহরের দিকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে জল দেওয়ার ব্যবস্থা আছে । তাতে বেশির ভাগ ট্যাপের বন্ধ করার কোন ব্যাবস্থা নেই । ফলে যতক্ষণ সময় জল দেওয়ার ততক্ষণ সময় ধরেই জল বেরিয়ে জল অপচয় হতে থাকে ।
গ্রামের দিকে সরকারি ভাবে যে স্বজলধারা দেওয়া হয়েছে । এক একটি গ্রামের জন্য এক একটি সেখানে জলট্রাঙ্ক বরাদ্দ করা হয়নি । ফলে সরাসরি মটর থেকে জল প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে চারিদিক ছড়িয়ে পড়ে , এবং গ্রামের প্রতিটি কল খোলা থাকে আর তা দিকে সমস্ত জল বেরিয়ে নর্দমায় গিয়ে পড়ে, এবং জলের ট্যাপ বন্ধ করতে বারণ করা থাকে । কারণ যদি কল গুলি বন্ধ রাখা হয় তাহলে জল সরবরাহের পাইপ ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে । তাই সরকারি ভাবে হয় এই সমস্ত স্বজলধারা গুলিকে বন্ধ করতে হবে , না হয় ট্যাঙ্কের ব্যবস্থা করতে হবে ।
পথ চলতি মানুষ যদি লক্ষ্য করে যে কোন ভাবে ট্যাপ খোলা আছে আর তা থেকে অনর্গল জল বেরিয়ে যাচ্ছে তাহলে সেটা বন্ধ করতে হবে এটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে ।
বাড়িতে যথেচ্ছভাবে জল ব্যবহারের মাধ্যমে জল অপচয় থেকে নিজেদের বেরিয়ে আসতে হবে ।
নতুন নতুন বিল্ডিং তৈরির জন্য যে প্রচুর পরিমাণে জলের প্রয়োজন তা থেকে দুরে থাকতে বিজ্ঞানকে নতুন কিছু ভাবতে হবে না হয় বর্ষার জলের উপর নির্ভর করতে হবে ।
৬ । বড় বড় শহরের বাড়ি গুলির ছাদে বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে , এবং সেই জলকে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে হবে ।
আমরা জেনেছি জল আমাদের জীবন , জল ছাড়া সমগ্র পৃথিবীটাই শুধুই মরুভূমি । তাই যেকোনো মূল্যে জলকে রক্ষা করতেই হবে । আমরা যেমন করে নিজে নিজে নিজেদের জীবন রক্ষা করতে তৎপর ও বদ্ধপরিকর ঠিক তেমন ভাবে জল রক্ষা করতে প্রত্যেকেই তৎপর ও বদ্ধপরিকর হতে হবে , দায়িত্ব নিতে হবে , প্রতিজ্ঞা করতে হবে কারণ আজ আমাদের সামনে প্রতিজ্ঞা করার দিন এসেছে । তাই চলুন সকলেই মিলে জল রক্ষা করি এবং হাতে হাত মিলিয়ে আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীকে আগামী দিনে আরো সুন্দর করতে সংকল্প গ্রহণ করি ।
Tags
Lifestyle