মনসুকা লক্ষ্মীনারায়ণ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইতিহাস
প্রাক্তন সহ-প্রধান শিক্ষক শ্রী বুদ্ধিমন্ত বেরা মহাশয় মনসুকা লক্ষ্মীনারায়ণ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইতিহাস নিয়ে একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। এই লেখাটি ১৯৯৫ সালে বিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবে প্রকাশিত পত্রিকা “মনসুকা লক্ষ্মীনারায়ণ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পণ” থেকে সংগৃহীত। প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বিদ্যালয়ের “উদয়ন” পত্রিকায়।
মনসুকা লক্ষ্মীনারায়ণ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং এর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি মূলত কৃষিপ্রধান এলাকা। এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝুমিনদী—দ্বারকেশ্বর নদের শাখা নদী শঙ্কেশ্বরী—বর্ষাকালে বন্যার সৃষ্টি করে গ্রামবাসীদের চরম দুর্ভোগের কারণ হলেও, পাট, আলু, সরষে, আমন ও বোরো ধানের ফলন তাদের জীবনধারণের প্রধান উৎস ছিল। এই কারণে, এখানকার মানুষের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষার প্রতি তেমন আগ্রহ দেখা যেত না। তাদের ধারণা ছিল, ছেলেরা বড় হয়ে বাবার কৃষি কাজে সাহায্য করবে। তাই গ্রামের পাঠশালায় সামান্য অক্ষরজ্ঞান লাভ করাই যথেষ্ট বলে মনে হতো। ফলে এই অঞ্চলে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তেমন উদ্যোগ ছিল না। বরকতিপুর বোর্ড প্রাইমারি স্কুলই ছিল এলাকার একমাত্র শিক্ষাকেন্দ্র। তবে কিছু উৎসাহী ব্যক্তি নিজেদের উদ্যোগে ছোট ছোট পাঠশালা স্থাপন করে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু পাঠশালা স্থাপন এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা ছিল, বিশেষত শিক্ষকের অভাব ছিল প্রকট। গ্রামের অধিকাংশ ছেলেই পাঠশালার প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে কৃষিকাজে যোগ দিত। বরকতিপুর বোর্ড প্রাইমারি স্কুল থেকে যারা উত্তীর্ণ হতো, তারাই এলাকায় শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। যারা আরও উচ্চশিক্ষা, বিশেষত ম্যাট্রিকুলেশন পড়তে আগ্রহী ছিল, তাদের প্রায় পাঁচ মাইল দূরের বীরসিংহ ভগবতী বিদ্যালয় অথবা শ্যামচকের বেনাবন পেরিয়ে ইড়পাল্লায় যেতে হতো। দূরত্বের কারণে এবং কৃষিকাজে সাহায্যের প্রয়োজনীয়তায়, অনেকেই দু-এক বছর পড়াশোনা করার পর বিদ্যালয় ছেড়ে বাবার কাজে যোগ দিত। শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা এই অঞ্চলের মানুষজন কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করাকেই যথেষ্ট মনে করত। তবে যখন চিঠি লেখা বা জরুরি কাগজপত্র পড়ার জন্য শিক্ষিত লোকের অভাব বোধ করত, কিংবা দূরের পথ পেরিয়ে যেতে হতো, তখনই তারা তাদের দুর্বলতা উপলব্ধি করত। যাদের মধ্যে শিক্ষার আলো সামান্য প্রবেশ করেছিল, তারা মনসুকা গ্রামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে চিন্তাভাবনা ও আলোচনা করতেন। কিন্তু শিক্ষক ও ছাত্রের অভাবের কারণে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি।
অবশেষে, ১৯৩২ সালে শ্রীযুত মহেন্দ্রনাথ পাড়ই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা শেষ করে বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। একদিন ৺ যোগেন্দ্রনাথ বাগের কাপড়ের দোকানে তিনি ৺ যোগেন্দ্রনাথ বাগ, ৺ কৃষ্ণদাস মণ্ডল এবং শ্রীযুত মহেন্দ্রনাথ পাড়ই একত্রিত হয়ে বিদ্যালয় খোলার বিষয়ে আলোচনা করেন। তারা এই বিষয়ে সাহায্যের জন্য এলাকার স্বনামধন্য ব্যক্তি স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র সামন্ত মহাশয়ের কাছে একটি আবেদন জানান। কিন্তু গ্রামে শিক্ষক ও ছাত্র সংগ্রহ করে বিদ্যালয় চালানো একটি বড় সমস্যা হবে, এই যুক্তিতে তিনি বিষয়টি প্রথমে তেমন গুরুত্ব দেননি। তবে শ্রীযুত মহেন্দ্রনাথ পাড়ই, যোগেন্দ্রবাবু ও কৃষ্ণবাবুর আন্তরিক উদ্দেশ্য জানতে পেরে তিনি সানন্দে বিদ্যালয় খুলতে রাজি হন। প্রাথমিকভাবে মাত্র ছয়জন ছাত্র জোগাড় করা সম্ভব হয়েছিল, যারা বরকতিপুর স্কুলের উচ্চতর শ্রেণির ছাত্র ছিল। মহেন্দ্রবাবু তাদের নিয়েই গ্রামের শিব মন্দিরের দোরে বিদ্যালয়ের শুভ সূচনা করেন। শ্রী রাধানাথ সামন্ত, ৺ কিশোরীমোহন বেরা, ৺ রাধানাথ মণ্ডল, ৺ তারকচন্দ্র জানা এবং ৺ কালিপদ মাইতি ছিলেন এই বিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষার্থী। ধীরে ধীরে ছাত্র সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। শিক্ষক হিসেবে এগিয়ে আসেন প্রসাদচক নিবাসী ৺ তপস্বীচরণ পোড়ে। তিনি কৃষ্ণবাবুর বৈঠকখানায় সামান্য অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসা করতেন। তিনি ছিলেন একজন সুদক্ষ চিকিৎসক এবং শিক্ষক হিসেবেও ছিলেন অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কৃষ্ণবাবুর বৈঠকখানাতেই অধ্যাপনার কাজ চলতে থাকে। নতুন বিদ্যালয়ের প্রথম ছয়জন ছাত্রই নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় ছাত্র সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়। এরপর বনহরি সিংহপুর নিবাসী ৺ লক্ষ্মীনারায়ণ গুছাইত বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। বিদ্যালয়ের নিজস্ব ভবনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হওয়ায় ঈশ্বরবাবু গ্রামবাসীদের সাহায্য চান। ধর্মের ডাঙায় ঘেঁটুবন ও বেলবন কেটে গ্রামের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তিনটি কক্ষবিশিষ্ট একটি ঘর তৈরি হয়। ৺ কালিপদ বাগ মহাশয় বিদ্যালয়ের নামকরণ করেন "NATIONAL SCHOOL"—বা ন্যাশনাল স্কুল। একটি পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়, যেখানে ৺ শ্রীবাস হাজরা, কৃষ্ণদাস মণ্ডল, যোগেন্দ্রনাথ বাগ, রজনীকান্ত পোড়ে, অভয় চরণ কর, গোবর্ধন আদক, গোবর্ধন সামন্ত প্রমুখ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সদস্য ছিলেন এবং ঈশ্বর বাবুকে সম্পাদক করা হয়। গ্রামের মানুষের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। এই সময় বরকতিপুর স্কুলের ছাত্র সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। সেই সময়ে ছাত্রদের দেওয়া বেতন এবং পঞ্চমীর চাঁদা ছিল শিক্ষকদের একমাত্র আয়। ছাত্র সংখ্যা বেশি হলে শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা হতো। বিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা কমে যাওয়া বিদ্যালয়ের জন্য অশুভ সংকেত ছিল। ভালো কাজের পথে বাধা আসে। ১৯৩৪ সালে হঠাৎ একদিন মহকুমাশাসক রেবতী চরণ দত্ত তার পুলিশ বাহিনী নিয়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন। "ন্যাশনাল স্কুল" নামটি তার একেবারেই পছন্দ হয়নি। তিনি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং খাতাপত্র দেখেন। মহেন্দ্রবাবু, তপস্বী বাবু, লক্ষ্মী বাবু এবং বিদ্যালয়ের সম্পাদকের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। মহেন্দ্রবাবুর বাড়িতে এম.এন. রায়ের একটি চিঠি এবং তপস্বী বাবুর বাড়িতে নিষিদ্ধ বই শরৎচন্দ্রের "পথের দাবী" ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। মহকুমাশাসক বিদ্যালয়ে তালা লাগিয়ে দেন এবং ঘোষণা করেন যে সরকারি অনুমতি ছাড়া বিদ্যালয় খোলা হলে শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সদস্যদের বিপ্লবী হিসেবে গণ্য করা হবে। এই পরিস্থিতিতে মহেন্দ্রবাবু হুগলি জেলার কাকনানে পালিয়ে যান এবং বিদ্যালয়টি আট মাস বন্ধ থাকে। বিদ্যালয়টি পুনরায় খোলার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। এই সময় মেদিনীপুরে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন চলছিল এবং পেডি ও ডগলাস বার্জকে হত্যা করা হয়েছিল। তাই "ন্যাশনাল স্কুল" নামটি কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।
কিছুদিন পর মহকুমাশাসকের বদলি হয় এবং ডি.এন. সাহা নামে একজন সদাশয়, দেশপ্রেমিক ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি নতুন মহকুমাশাসক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি বিদ্যালয়ের সম্পাদক ঈশ্বরবাবুকে খবর দিয়ে বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসেন। গ্রামের মানুষের উৎসাহ দেখে তিনি অভিভূত হন। তিনি পরামর্শ দেন যে পুরনো শিক্ষকদের পরিবর্তন করতে হবে, পরিচালনা কমিটি পুনর্গঠন করতে হবে এবং স্কুলের নাম পরিবর্তন করতে হবে। তাহলে বিদ্যালয় খোলার অনুমতি পাওয়া যেতে পারে। এছাড়াও, তিনি একজন সরকারি প্রতিনিধি রাখারও পরামর্শ দেন। মহকুমাশাসকের উপস্থিতিতে একটি নতুন পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়, যেখানে দীর্ঘগ্রামের সুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী, লক্ষ্মীনারায়ণ রায়, নদের চাঁদ বেরা, ঈশ্বরচন্দ্র সামন্ত এবং সার্কেল অফিসার (সরকারি প্রতিনিধি) সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। গ্রামবাসীদের একান্ত আগ্রহের কারণে বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় "মনসুকা লক্ষ্মীনারায়ণ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়"। যদিও ঈশ্বরবাবুর এতে আপত্তি ছিল, তবে তিনি দেশবাসীর সম্মিলিত ইচ্ছাকে উপেক্ষা করতে পারেননি। নতুন শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন বসন্ত কুমার আচার্য, নিশাপতি রায় এবং বসন্ত বাবুর প্রিয় ছাত্র মাধবচক নিবাসী কানাইলাল দোলই। ১৯৩৫ সাল থেকে বিদ্যালয় সরকারি মঞ্জুরি লাভ করে।
বসন্ত বাবু বিদ্যালয় ত্যাগ করলে কিশোরপুর নিবাসী শ্রদ্ধেয় শ্রীযুত রাখালচন্দ্র পাখিরা মহাশয় প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি যোগেনবাবুর বাড়িতে থাকতেন এবং বিদ্যালয়ই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। তিনি ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের খোঁজ নিতেন এবং অবসর সময়ে তাঁত বুনতেন। এমন ছাত্রদরদী শিক্ষক বিরল। ছাত্রদের চরিত্র গঠনে তার বিশেষ নজর ছিল। ১৯৩৬ সালে শ্রীযুত গুনধর সাঁতরা ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ লাভ করেন, যা গ্রামবাসীদের মধ্যে নতুন উৎসাহের সঞ্চার করে। বর্তমানে যেখানে বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবন (অফিস) অবস্থিত, সেখানে গ্রামবাসীদের সাহায্য ও সহযোগিতায় একটি খড়ের চাল এবং বাঁশের বেড়ার ঘর তৈরি করা হয়। পূর্বের দক্ষিণমুখী বেড়ার ঘরটিতে ছাত্রদের স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। বিদ্যালয়ের সম্পাদক ঈশ্বরবাবু পুনরায় গ্রামবাসীদের সাহায্য চান। পুরনো বেড়ার ঘর ভেঙে ফেলে মাটি দিয়ে ছয়টি কক্ষবিশিষ্ট একটি দোতলা ভবন নির্মাণ করা হয়। গ্রামের মানুষ স্বেচ্ছাশ্রম দান করেন। ঈশ্বরবাবুর চন্দ্রকোনার পুকুর পাড়ের তালগাছ কেটে আনা হয় এবং কৃষ্ণবাবু তা বহন করে আনেন। ঈশ্বরবাবু টিনের ছাউনির ব্যবস্থা করেন। বরকতিপুর নিবাসী ৺ গুইধর সেন স্কুলের প্রয়োজনীয় টেবিল, চেয়ার ও বেঞ্চ দান করেন।
১৯৩৯ সালে বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি খোলা হয় এবং খাসবাড় নিবাসী তীর্থকুমার প্রধান প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন একজন আইনজীবী। এই সময় নিশাপতি রায় বিদ্যালয় ত্যাগ করলে ৺ রামচরণ পোড়ে ও শ্রীযুত রাধানাথ সামন্ত বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ৺ কালিপদ বাগ মহাশয় প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে শিক্ষাদান করতেন এবং বিদ্যালয়ের পঠনপাঠনের দায়িত্ব তিনিই নিয়েছিলেন।
এই বছর থেকেই বিদ্যালয়ে কৃতী ছাত্রদের পুরষ্কার দেওয়ার প্রথা চালু হয়। ১৯৪০ সালের ৭ই ডিসেম্বর মদনবাটী নিবাসী শ্রীযুক্ত সাধনচন্দ্র জানা মহাশয় বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী, নাট্যকার ও অভিনেতা। তার লেখা নাটক "বাংলার দস্যু", "দেবকী" ও "পলাশী" বিদ্যালয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠানে অভিনীত হতো। ছাত্ররাই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। কর্মজীবনে ছাত্র ও বিদ্যালয় ছাড়া তিনি আর কিছুই জানতেন না। বাড়ির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। তার এবং প্রধান শিক্ষক তীর্থবাবুর আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়ে নিয়মিত থিয়েটার হতো। বিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রদের পুরষ্কার বিতরণের দিন নির্ধারিত হয় ২০শে বৈশাখ। এই দিনেই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ঈশ্বরচন্দ্র সামন্ত মহাশয়ের পিতৃদেব ৺ লক্ষ্মীনারায়ণ সামন্ত মহাশয় পরলোকগমন করেছিলেন। প্রতি বছর এই দিনে ঈশ্বরবাবু ছাত্র, শিক্ষক ও এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। সকালে প্রভাতফেরী, লক্ষ্মীনারায়ণ সামন্ত মহাশয়ের সমাধিমন্দিরে মাল্যদান ও জলযোগ, বিদ্যালয়ে কানাইবাবুর পরিচালনায় নানাপ্রকার খেলাধুলা ও ড্রিল, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা পুরষ্কার বিতরণ এবং দুপুরে সামন্ত বাড়িতে ভুরিভোজের আয়োজন করা হতো। সন্ধ্যায় থিয়েটার অনুষ্ঠিত হতো। এই অনুষ্ঠানই বিদ্যালয়ের স্মৃতি বার্ষিকী অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।
১৯৪৩ সালের বৃত্তি পরীক্ষায় বিদ্যালয় থেকে ৺ ভূপাল চন্দ্র কর ও শ্রী গুণধর কুঁতি বৃত্তি লাভ করেন। ভূপাল বাবু আবার জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেন, যা গ্রামবাসীদের উৎসাহ আরও বাড়িয়ে তোলে। তারা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। যোগেনবাবু ও কৃষ্ণবাবু ঈশ্বরবাবুকে উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানান। উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন এবং শিক্ষকের অভাব একটি বড় সমস্যা ছিল। বিশেষ করে গ্রামে শিক্ষকরা আসতে চাইতেন না। তবে গ্রামবাসীরা চাঁদা ও শ্রম দান করে এবং ভিক্ষা করে অর্থ সংগ্রহের প্রতিশ্রুতি দিলে ১৯৪৩ সাল থেকেই ষষ্ঠ শ্রেণি খোলা হয়। মহেন্দ্রবাবু মনসুকায় ফিরে আসেন। ১৯৪৪ সালে সপ্তম শ্রেণি খোলা হয় এবং ১৯৪৫ সালে অষ্টম শ্রেণি খোলার জন্য সুলতানপুর নিবাসী অচ্যুতানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়কে নিয়ে আসা হয়। পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এরপর ঐ গ্রামেরই একজন বিপ্লবী জহরলাল বক্সী (বি.এ.) মহাশয় বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি খোলার জন্য প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়ে আসা হয় ময়াল নিবাসী পার্বতীচরণ মণ্ডল (বি.এ. বি.এল.) মহাশয়কে। তিনি ঈশ্বরবাবুর বাড়িতেই থাকতেন।
১৯৪৫ সাল থেকেই বিদ্যালয়টি নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের অনুমোদন লাভ করে। সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন শ্রীযুক্ত বুদ্ধিমন্ত বেরা ও স্বর্গীয় সুবলচন্দ্র চৌধুরী। শ্রদ্ধেয় সুবল বাবু ছিলেন জন্মগত শিক্ষক। অঙ্ক, ইংরেজি, বাংলা ও সংস্কৃতে তার অসাধারণ দক্ষতা ছিল। তিনি ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন। বিদ্যালয়ের অগ্রগতিতে তার অবদান অনস্বীকার্য।
বিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা ছিল কম এবং ছাত্রদের মাসিক বেতন বাবদ আয় ছিল মাত্র ১৪৬ টাকা। বছরে মাত্র তিনবার পরীক্ষার সময় বেতন আদায় করা হতো। ফলে শিক্ষকদের প্রায় ১৮/২০টি কিস্তিতে মাসের বেতন নিতে হতো। আদায় করা বেতনের ঘাটতি ঈশ্বরবাবু নিজেই পূরণ করতেন। গ্রামের উৎসব অনুষ্ঠানে ব্যয় না করে সেই অর্থ বিদ্যালয়ের তহবিলে দেওয়া হতো। গ্রাম কমিটিও বাড়ি বাড়ি ঘুরে কিছু অর্থ সংগ্রহ করে বিদ্যালয়ের জন্য দিত। ধীরে ধীরে বিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং বিদ্যালয়টিকে আরও উন্নত করার প্রচেষ্টা চলতে থাকে। ১৯৪৭ সালে বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি খোলা হয় এবং একজন পণ্ডিতের প্রয়োজন হয়। বরকতিপুর নিবাসী ৺ হরেন্দ্রনাথ কাব্যতীর্থ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এই সময় বিদ্যালয় জুনিয়র হাইস্কুলের অনুমোদন লাভ করে। ১৯৫২ সালে করণিক হিসেবে যোগদান করেন ৺ ভূপাল চন্দ্র কর। ছাত্র বৃদ্ধির কারণে বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের প্রয়োজন হয় এবং একটি পাকা বাড়ি নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। এই সময় উদয়রাজপুরে ১০০ টাকায় একটি পুরনো পাকা বাড়ি কিনে তার ইট খুলে আনা হয়। শ্রীযুত সুধীর চন্দ্র সাঁতরা ও শ্রীযুত সতীশ চন্দ্র সামন্তের নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা ইট আনতে যান এবং তত্ত্বাবধানে ছিলেন ৺ কৃষ্ণদাস মণ্ডল। ৺ অতুলচন্দ্র দোলই মহাশয়ের নৌকায় বিনামূল্যে ইট আনা হয় এবং কৃষ্ণবাবুর জমিতে ইট কাটা হয়। ১৯৪৮ সালে নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ছয়টি কক্ষবিশিষ্ট একটি পাকা বাড়ি তৈরি হয়। গ্রামের মানুষ বাড়ি বাড়ি গিয়ে শ্রমিক সাহায্য দেন। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে কেউ বাঁশ, আবার কেউ নগদ অর্থ দান করেন। এভাবে পাকা বাড়ির কাজ শেষ হয়। এই ভবন নির্মাণে ঈশ্বরবাবুকে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয়। ১৯৪৮ সালে নবম শ্রেণি খোলার চেষ্টা করা হলেও তা কার্যকর হয়নি। এই সময় শিক্ষকদের ধরে রাখাই ছিল একটি বড় সমস্যা। হরেন্দ্রনাথ কাব্যতীর্থ মহাশয় ময়াল চলে যান এবং তার স্থলে বীরসিংহের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দীর্ঘগ্রাম নিবাসী ৺ নলিনীকান্ত কাব্যতীর্থ যোগদান করেন। হাইস্কুল খুলতে গেলে এম.এ. পাশ প্রধান শিক্ষকের প্রয়োজন ছিল।
ইড়পাল্লা গ্রামের অভিজাত রুদ্র পরিবারের সন্তান স্বর্গীয় সমরেশ চন্দ্র রুদ্র সরকার (এম.এ.) বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ৺ ঈশ্বরচন্দ্র সামন্ত মহাশয়ের অনুরোধে ১৯৫১ সালের ১২ই জুলাই প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তখন হাইস্কুলের ছাত্র সংখ্যা ছিল ১২০/১২১ জন এবং প্রধান শিক্ষক সহ মোট শিক্ষক ছিলেন মাত্র ছয়জন। ১৯৫১ সালেই স্কুলটির সরকারি অনুমোদনের জন্য চেষ্টা করা হয়, কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব এবং বিদ্যালয়ের রিজার্ভ ফান্ডে অর্থের স্বল্পতার কারণে বিদ্যালয় সরকারি অনুমোদন পায়নি। বিদ্যালয়ে ছাত্রাবাস না থাকায় বাইরের কোনো শিক্ষক বিদ্যালয়ে আসতে চাইতেন না। এই সময় কুঞ্জবাবু নদের চাঁদ বেরা মহাশয়ের বাড়িতে এবং সমরেশ বাবু যোগেনবাবুর বাড়িতে থাকতেন। তাছাড়া, অননুমোদিত বিদ্যালয় হওয়ায় কোনো সরকারি সাহায্য পাওয়া যেত না। এই সময় বিদ্যালয়ের গঠনে গ্রাম কমিটিতে ছিলেন নদের চাঁদ বেরা, রাধাগোবিন্দ বেরা, কৃষ্ণদাস মণ্ডল, রজনীকান্ত পোড়ে, বসুদেব সামন্ত, সতীশ চন্দ্র সামন্ত, মহেন্দ্রনাথ সামন্ত ও যোগেন্দ্রনাথ বাগ। এঁরা বিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধানে সর্বতোভাবে সাহায্য করতেন।
১৯৫২ সালে উপায়ান্তর না দেখে প্রধান শিক্ষক মহাশয় তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্রে খড়ারের শম্ভু কর্মকার (বি.এস.সি.) ও দীর্ঘগ্রামের রাধানাথ হাজরা (বি.এল.) কে নিয়ে আসেন। স্কুলে খাতায় তাদের নাম ছিল। বিদ্যালয় মঞ্জুরীর জন্য পুনরায় আবেদন করা হয় এবং ১৯৫৩ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে "মনসুকা লক্ষ্মীনারায়ণ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়" সরকারি অনুমোদন লাভ করে। ১৯৫৪ সালে বিদ্যালয়ে যোগদান করেন বলরামপুর নিবাসী শ্রীযুক্ত মাণিকলাল মাইতি (বি.এস.সি.) এবং বরিশালের অনন্তকুমার সেন (বি.এ., বি-টি) ও সদ্য পরীক্ষা দেওয়া দীর্ঘগ্রামের শ্রীযুত বিশ্বনাথ চক্রবর্তী। ১৯৫৪ সাল থেকেই বিদ্যালয়ের ছাত্ররা স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় বসতে শুরু করে। ১৯৬৫ সালে মাণিক বাবুর পরিবর্তে গড়প্রতাপ নগরের প্রদ্যোংকুমার মণ্ডল (বি.এস.সি.) যোগদান করেন। পরে রামগোপাল দত্ত আসেন এবং তিনিও চলে যান। ১৯৫৭ সালে ঐ পদে আসেন রমেশ চন্দ্র গাঙ্গুলী। তিনি ছিলেন আত্মভোলা এবং গভীর জ্ঞানের অধিকারী। প্রয়োজনে নিজের সামান্য সঞ্চিত অর্থ শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার জন্য ধার দিতেন। এরপর আসেন বীরভূমের অসীম কুমার দে সরকার (বি.এস.সি.)।
১৯৫৮ সালের ৩রা ডিসেম্বর বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রাতঃস্মরণীয় ঈশ্বরচন্দ্র সামন্ত মহাশয় পরলোকগমন করেন। এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। এই সময় বিদ্যালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ৺ ঈশ্বরবাবুর সুযোগ্য ছোট ভাই ৺ ভজহরি সামন্ত মহাশয়। তার পরিচালনায় বিদ্যালয়ের উন্নতি অব্যাহত থাকে। উল্লেখ্য, বিদ্যালয়ে প্রাথমিক বিভাগের পৃথক কোনো অনুমোদন ছিল না। স্কুল বোর্ডের সভাপতি অনঙ্গমোহন দাসকে ২০শে বৈশাখ পুরস্কার বিতরণী সভায় আনা হয় এবং তার চেষ্টাতেই ১৯৫৪ সাল থেকে প্রাথমিক বিভাগ আলাদা অনুমোদন লাভ করে।
সহকারী প্রধান শিক্ষক অনন্ত বাবুর চেষ্টায় ১৯৫৩ সাল থেকেই মনসুকার কাছারি বাড়িতে ও পরে মহেন্দ্রবাবুর বাড়িতে বোর্ডিং চালু হয়।
১৯৬০ সাল থেকে বিদ্যালয়ের কাজে যোগদান করেন যদুপুর নিবাসী শ্রীযুক্ত নিমাই চন্দ্র চক্রবর্তী ও মনসুকা নিবাসী শ্রীযুক্ত মদনচন্দ্র মণ্ডল। এই বছর থেকেই বিদ্যালয়ে সহ-শিক্ষক প্রথা চালু হয়। ১৯৬৪ সালে যোগদান করেন শ্রীযুত পানালাল বসু, শীযুত সৃষ্টিধর চংদার ও শীযুত অজিত কুমার ঘোষ। ১৯৬৫ সালে স্বর্গীয় সমরেশ চন্দ্র রুদ্র সরকার প্রধান শিক্ষক মহাশয় শারীরিক অসুস্থতার কারণে অবসর নেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ছাত্রদরদী। পরবর্তীকালে সুযোগ পেয়েও তিনি অন্য কোথাও প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দেননি। তার শূন্য পদে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে আসেন রাজনগর নিবাসী ৺ বঙ্কিম বিহারী সামন্ত। তিনি ১৯৮২ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু এই পদ সামলেছেন। তার সময়ে ১৯৬৭ সাল থেকে বিদ্যালয়টি উচ্চতর মাধ্যমিক (XI Class) স্কুল হিসেবে কলা ও বিজ্ঞান বিভাগ সহ অনুমোদন লাভ করে।
বিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বিদ্যালয়ে যোগদান করেন অসিতকুমার বিশ্বাস, অমিয়রঞ্জন সামন্ত, নরেন্দ্রনাথ ভাদুড়ী, শৈলেন্দ্র নাথ অধিকারী, পরেশনাথ ভুঁঞা এবং ১৯৭২ সালে কালীপদ চক্রবর্তী। একে একে শিক্ষক পদে যোগদান করেন জীতেন্দ্রনাথ পাল, পীযূষকান্তি ঘোষ, দিলিপকুমার বাগ, গণপতি সামন্ত, বিজয়কুমার বেরা ও শম্ভুনাথ চক্রবর্তী এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে তারাপদ বারিক ও শ্রীমতী দিগার ১৯৬১ সাল থেকে ও নিমাই জানা ১৯৭২ সাল থেকে যোগদান করেন। শিক্ষক সুভাষ চন্দ্র চৌধুরী ১৯৭০ সালে বিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং ৺ দুঃখীরাম দোলই গবেষণাগার সহায়ক হিসেবে যোগ দেন।
বিদ্যালয় উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত হওয়ায় ঘরের সমস্যা আরও তীব্র হয়। বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি কেনার জন্য অর্থের প্রয়োজন এবং জায়গারও দরকার হয়। তাই বিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি দান করেন ৺ কৃষ্ণদাস মণ্ডল, ৺ শ্রীচরণপতি মণ্ডল, ৺ ক্ষুদনবালা খাঁ, মহেন্দ্রনাথ পাড়ই, কিশোর চন্দ্র মাজি, নিতাইচন্দ্র সাঁতরা ও ৺ লক্ষনচন্দ্র ধাড়া। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ৺ ঈশ্বরচন্দ্র সামন্ত বিদ্যালয়ের আর্থিক সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক জমি বিদ্যালয়কে দান করেছিলেন। বিদ্যালয়ের উন্নতি কল্পে অর্থ দান করেন হাওড়া নিবাসী ৺ শ্রীরামচন্দ্র মিদ্যা, ৺ ভজহরি পাড়ই, মনসুকা নিবাসী ৺ বিপিন চন্দ্র সামন্ত, ৺ তিনকড়ি বালা সামন্ত ও ৺ সত্যবালা সামন্ত। উক্ত দাতা ও গ্রামবাসীদের সাহায্য সহযোগিতায় বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি কেনা হয়। কিন্তু গৃহ সমস্যা সমাধান করা গ্রামের কৃষি নির্ভর মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সামন্ত বংশের সুযোগ্য সন্তান শ্রীযুত গোবিন্দপদ সামন্ত মহাশয়ের প্রচেষ্টায় এবং কন্দর্পচক নিবাসী ৺ মদন মোহন বেরা ও ৺ বঙ্কিম বিহারী পোড়ে শ্রী সতীশ চন্দ্র সামন্ত ও ৺ শচীন্দ্র নাথ খাঁ এর সহযোগিতায় হাওড়া নিবাসী ভুতোড়িয়া ব্রাদার্সের দানে একটি আট কামরা বিশিষ্ট দোতলা বাড়ি তৈরি হয়। ভুতোড়িয়া ব্রাদার্সের এই অমূল্য দানের প্রধান মাধ্যম ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীযুত পুনমচাঁদ জৈন (ক্যান্টিন বাবু) ও এককড়ি রায়। এই বাড়ির জন্য শ্রীযুত রাধানাথ সামন্ত তার নিজের জায়গা পরিবর্তন করে বিদ্যালয়কে দান করেন এবং হরেন্দ্রনাথ দোলই এর জায়গাও পাওয়া যায়। এই ভুতোড়িয়া ভবন তৈরিতে গ্রামের মানুষের সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। প্রাক্তন ছাত্ররা দিনরাত পরিশ্রম করে পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাঁশ সংগ্রহ, ইট বহন ও ভিত কাটার কাজে সহযোগিতা করেন। ১৯৭২ সালে এই ভুতোড়িয়া ভবনের উদ্বোধন হয়। এই ভবন তৈরি না হলে ছাত্রদের গাছতলায় বসতে হতো।
যারা আগে উচ্চতর মাধ্যমিক খোলার অনুমোদন পেয়েছিল, তারা শিক্ষক পেয়েছিল, কিন্তু মনসুকা স্কুল উচ্চতর মাধ্যমিকের জন্য কোনো বাড়তি শিক্ষক পায়নি। অতএব শিক্ষক সমস্যা রয়েই গেল। তাই পরবর্তীকালে যখন ১০+২ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় করার চেষ্টা হয়, তখন বিদ্যালয় গৃহ, ফিডার স্কুল ও উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবে দ্বাদশ শ্রেণি খোলা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৮ সাল থেকে বিদ্যালয়ে যোগদান করেন সিংহপুর নিবাসী অজিত কুমার সামন্ত, রেবতী রমণ মণ্ডল, অমরেন্দ্রনাথ চৌধুরী, সৌমেন মাজী, শ্রীমতী তপতী সামন্ত, কিংকর কুমার বেরা, তাপস কুমার রায় ও বিশ্বনাথ মণ্ডল এবং রবীন্দ্র নাথ বাগ ও অশ্রুজিৎ মণ্ডল। করণিক পদে আসেন রমেশ অভিরাম দোলই ও অসিতবরণ শাল এবং মেট্রন পদে আসেন শ্রীমতী সান্ত্বনা পালধি। ১৯৮২ সালের ২৭শে জানুয়ারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কর্মযোগী বঙ্কিম বিহারী সামন্তের অকাল প্রয়াণে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য হয়। তার মৃত্যুতে ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবক সকলেই গভীরভাবে শোকাহত হন। কারণ বিদ্যালয়ই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান, বিদ্যালয়ের কাজই ছিল তার সবচেয়ে বড় কাজ। সহকারী শিক্ষকদের সাথে কোনো কারণে কথা কাটাকাটি হলেও তিনি তা মনে রাখতেন না। তার মৃত্যুর এক ঘণ্টা আগে বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে লেখা চিঠিটি প্রমাণ করে, তিনি বিদ্যালয়কে ও তার সহকর্মীদের কতটা ভালোবাসতেন। স্কুলের জন্য তিনি বাড়ির কথা একরকম ভুলেই গিয়েছিলেন।
১৯৮২ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর বন্দর নিবাসী শ্রীযুত বনমালী ঘোড়া মহাশয় প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার নেন। আদর্শবাদী, সময়নিষ্ঠ ও অক্লান্তকর্মী প্রধান শিক্ষক হিসেবে তার যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। বিদ্যালয়টি যাতে দ্বাদশ শ্রেণিযুক্ত উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত হতে পারে, তার জন্য তিনি পরিচালনা কমিটির সঙ্গে একযোগে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শিব মন্দির প্রাঙ্গণে মাত্র ছয়জন ছাত্র নিয়ে যে বিদ্যালয়ের সূচনা হয়েছিল, তা আজ এক মহীরূপে পরিণত হয়েছে। বিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্র সংখ্যা এক হাজারের বেশি এবং শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর সংখ্যা ৩১ জন। মনসুকা ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির সাহায্য সহযোগিতায় বিদ্যালয়টি দিন দিন উন্নতি লাভ করছে। বর্তমান পরিচালনা কমিটি পঞ্চায়েত সমিতি থেকে ৬০ হাজার টাকা অনুদান পাওয়ায় বিদ্যালয়ের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। আজ এই বিদ্যালয়ের কল্যাণে ঘরে ঘরে মাধ্যমিক পাশ করা ছেলে মেয়ে রয়েছে। যারা প্রাণপাত পরিশ্রম করে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন, এখন তাদের পরিশ্রম ফলপ্রসূ হয়েছে।
ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে একটি বড় জিনিসকে ধারণ করতে গেলে যেমন তার সঠিক রূপ বজায় রাখা যায় না, তেমনি বিদ্যালয়ের যারা প্রকৃত রূপকার, তাদের অবদানের যথার্থ বিবরণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। লোকশ্রুতি ও স্মৃতিমন্থন করে যেটুকু সংক্ষেপে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি, তাতে ত্রুটি থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
Comments
Post a Comment