শ্যামল রং, "মনসুকা খবর" মনসুকা: কুলকুলোতি ব্রত এর শেষ দিন কার্তিক সংক্রান্তি। এটি একটি গ্ৰামীন লোকাচার, পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। আবার কুলের মঙ্গল কামনাতেও এই ব্রত হয়ে থাকে। আবার অন্য মতে ভালো বর (স্বামী) পাওয়ার জন্য এই ব্রত করে কুমারী মেয়েরা । কোনো কোনো স্থানে বিবাহিত মহিলাদেরও এই পুজো করতে দেখা গেছে। কার্তিক মাসের প্রথম দিন থেকে এই ব্রত পালনের রীতি চালু আছে।চলে কার্তিক সংক্রান্তি পর্যন্ত। তবে এই ব্রত তপশীল জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের শ্রেণীভূক্ত পরিবারে মহিলারা করে থাকেন।
কুল প্রতিহত তুলসী তলায় গর্ত খুঁড়ে প্রতি সন্ধ্যায় সেখানে ফুল সাজানো হয়, বিভিন্ন ফুল দিয়ে সাজানো হয় গর্তের চারপাশে। এই ব্রতের প্রধান ফুল শালুক/ শাপলা। কুলগাছের পাতা, দূর্বাঘাস ও তুলসী পাতা দিয়ে দেবীর উদ্দেশ্যে গান গাওয়া হয়। আবার অনেকে তুলসী তলায় একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে আর টুকরো করে কাটা কলাগাছের খোলের ওপর প্রদীপ জ্বালিয়ে কিছু ফুল দিয়ে সেই কলার ভেলাটি পুকুরে বা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ভাসানোর সময় ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা গান গাইতে থাকে। আর ভেলা আলো নিয়ে যায় পূর্ব প্রজন্মের মানুষদের কাছে।
সাধারণত ছোট ছোট মেয়েরাই এই ব্রত করে থাকে। মা-কাকিমাদের শাড়ি পরে গিন্নীর মতো সেজে প্রদীপ জ্বালানো,শাঁখ বাজানোর ব্রত যেন গার্হস্থ্য জীবনের হাতেখড়ি।কার্তিক মাসের প্রথম দিন থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনটি কুলপাতা, তিনটি দূর্বাঘাস ও তিনটি প্রদীপে তেল সলতে দিয়ে সাজাতে হয়। এরপর পুকুর থেকে জল আনতে হয় একটি পাত্র করে।জল আনার সময় পুকুর ঘাটে গান গাইতে হয়....
"শালুক ডাঁটার সলতে
প্রদীপ তবু জ্বলছে
জলে আছে জলকুমারী,
ডাঙায় আছে হরি।
এক ঘটি জল দাও মা,
হরি পূজা করি।
"জল এনে তুলসী তলায় জল ঢেলে প্রদীপ জ্বালানো হয় গান গেয়ে....
"সাঁঝ সলতে পরমবাতি,
সন্ধ্যে দেখায় ভগবতী।
কোথায় আছে দেবগণ,
সন্ধ্যে দেখায় নারায়ণ।"
বা,
কুলকুলোতি কুলের বাতি
সন্ধ্যে দেখায় সরস্বতি।
যত আছে দেবগণ,
তত আছে নারায়ণ।
"তারপর পূজার মন্ত্র....
কুলকুলোতি কুলোবতী,
সাত ঘরে দিয়ো বাতি।
অরুণ ঠাকুর বরণে,
ফুল ফুটেছে তরুণে।
এই ফুলটি যে নেবে,
সাত ভাইয়ের বোন হবে।
কার্তিক মাসে রাসে,
ধূপ-ধূনো ভাসে।
ফুলমালা আর আলোর মালা,
ছোট্টো ভেলা দোলায় দোলা।
কুলোবতীর হাতের নাড়া,
ভেলা ভাসে গন্ধে ভরা।
এই গন্ধ যেদিক যায়,
সাতভাই পাই সেথায়।
এসো আমার সাতভাই,
তার জন্য ভেলা ভাসাই।
সাতটি ঘরে বাতি দিই,
কুলোবতীর পুণ্যি নিই।
দেহের ঘর শুদ্ধ করি,
তোমায় ঠাকুর গড় করি।"
এরপর তুলসী গাছে ঢালার সময় গাওয়া হয়...
"তুলসী তুলসী মাধবলতা,
ও তুলসি, কৃষ্ণ কোথা?
কৃষ্ণ গেছে গোচারণে।
তোমার শিরে ঢালি জল,
অন্তর থেকে দিও ফল।"...
তিনবার এই গান গেয়ে হাত জোড় করে কিশোরীরা বাড়ির মঙ্গল কামনা করে।
এই গান গাওয়ার পর কুলপাতা দেওয়ার পর্ব শুরু হয়।তখন গাওয়া হয়...
"কুলপাতা কুলপাতা ঝাঁকড়ী,
সতীন বেটা মাকড়ি।
সাত সতীনের সাত কৌটা,
আমার মায়ের নব কৌটা।
নব কৌটা নড়ে চড়ে,
সাত সতীনের মুখটি পুড়ে।।"
সব শেষে শাঁখ বাজানোর সময় গাওয়া হয়...
"শাঁখে জল দিয়ে বাজাই শঙ্খ ধ্বনি,
বিদায় করো মা মহারানী।।"