বাংলাদেশের টাঙ্গাইল আর নোয়াখালির দুটো মেয়ে আঁখি আর বিলকিস; পরস্পরকে ভালোবাসে, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা বিয়ে করবে এবং একসঙ্গে বাস করবে। এতে পুরুষকুল বড় রাগ করছে। তারা মনে করে মেয়েতে মেয়েতে প্রেম বিয়ে হতে পারে না, কারণ মেয়েদের তো সেই অস্ত্রই নেই, যে অস্ত্র দিয়ে একজন আরেকজনকে ঘায়েল করবে, বশে রাখবে! আসল সত্যিকার প্রেম থাকলে কাউকে ঘায়েল করার বা বশে রাখার দরকার হয় না।
অস্ত্রের বাহাদুরি দেখাতে না পারলে পুরুষকুল হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। দুটো মেয়ে পুরুষের নাগাল থেকে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে গেল, কোনও পুরুষকেই এতটুকু সম্ভ্রম না দেখিয়ে, এ কী করে সহ্য হয় পুরুষকুলের? মেয়ে দুটো বলেছে, 'আমাদের মেরে ফেলতে চাইলে, একসঙ্গে দুজনকেই মেরে ফেলো, আমরা মরতে রাজি, কিন্তু পরস্পরকে ছাড়া বাস করতে রাজি নই।' কী স্পর্ধা, তাই না? চিরকাল তো পুরুষের স্পর্ধাই দেখেছি। মেয়েদের স্পর্ধা অতি দুর্লভ। এই দুর্লভ জিনিসটিকে শ্রদ্ধা জানাতে আপামর জনতার উচিত ঘটা করে এখন আখিঁ আর বিলকিসের বিয়ে দেওয়া।
সমকামী কি কম আছে ঘরে ঘরে! মুখ বুজে বিষমকামীর সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমোতে বাধ্য হচ্ছে। সমাজের দুষ্ট আর মূর্খগুলোকে তোয়াক্কা না করে তারা যদি এখন বলে, 'আমরা সমকামী, আমরা পুরুষকে বর্জন করছি', যদি ক্লোজেট থেকে বেরিয়ে আসে সমকামী মেয়েরা, তাহলে এ তাদের জন্যও মঙ্গল, সমাজের জন্যও মঙ্গল।
পুরুষের দাসি বাঁদি হওয়া থেকে বাঁচার জন্য, পুরুষের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য, পুরুষ দ্বারা ধর্ষণ আর খুন হওয়া থেকে বাঁচার জন্যও তো মেয়েরা সমপ্রেমী / সমকামী হতে পারে! পুরুষের নারীবিদ্বেষী চরিত্রের প্রতিবাদ করেও তো হতে পারে! একবার একযোগে হয়ে যাক না সবাই! পুরুষরাও যত বেশি সমকামী হবে, মেয়েরা তত রেহাই পাবে। সমাজে সমকামীর সংখ্যা বাড়ুক,পুরুষতন্ত্র নামক রোগ থেকে সমাজ মুক্ত হোক, সমাজ সুস্থ হোক।সভ্য দেশগুলোয় সমকামিতা বৈধ, সমকামীদের বিয়ে বৈধ, সমকামীদের সন্তান দত্তক নেওয়া বৈধ, সেই সন্তানের উত্তরাধিকার বৈধ। সভ্য হতে হলে এ সবই বৈধ করতে হবে।
নারী পুরুষের সম্পর্কই শুধু প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক, তা ঠিক নয়। যা প্রকৃতিতে বিরাজ করে, তা-ই প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক। প্রকৃতিতে সমকামিতার অস্তিত্ব আছে, তাই এটি প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক। প্রকৃতিতে উভকামিতার অস্তিত্বও আছে, তাই উভকামিতাও প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক। বলতে পারো বিষমকামিতা বা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণের সংখ্যা বেশি। যে কামিতা সংখ্যায় বেশি শুধু সেটিকে স্বাভাবিক বলবে, আর যে কামিতা সংখ্যায় কম, সেটিকে অস্বাভাবিক যদি বলো, তাহলে তুমি মূর্খ ছাড়া কিছু নও। মূর্খদের দাবি অনুযায়ী দেশের আইন আর সমাজের নিয়ম চললে সেই আইন এবং নিয়ম দুটোই হয় মূর্খ।
সরকার তার মূর্খামি ত্যাগ করে অতি দ্রুত সমকামীদের প্রাপ্য অধিকারে বাধা প্রদান বন্ধ করুক। বিষমকামীদের যা অধিকার, সমকামীদের একই অধিকার। পুরুষের যা অধিকার, নারীরও একই অধিকার। আসল কথা, মানুষের অধিকার সর্বত্র থাকা চাই এক এবং অভিন্ন।
সমকামীরা যদি একত্র বাস করতে চায়, তাদের একত্রবাসে যেন মূর্খ সমাজ বাধা না দেয়, যদি বিয়ে করতে চায়, তাদের বিয়েতে এবং বিবাহত্তোর জীবন যাপনে যেন মূর্খ সমাজ বাধা না দেয়, সরকারকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্মে, লিঙ্গে,বিশ্বাসে, যৌন-আচরণে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের।
সাহসী মেয়ে আঁখি আর বিলকিস অসভ্য সমাজকে সভ্য বানানোর ইতিহাস তৈরি করুক।
-----তসলিমা নাসরিন