শ্যামল রং,১৮ আগস্ট, ২০২৪: বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেকের নামই আলোচিত হয়েছে নানা সময়ে। কিন্তু এবার খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান এবং পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আই এস আই)-এর মধ্যে সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রের বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের সূত্র ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
তসলিমা নাসরিন, যিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে অবস্থান করছেন, তাঁর সাম্প্রতিক লেখায় এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তসলিমার মতে, তারেক রহমানের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আই এস আই-এর প্রভাব ছিল গভীর এবং পরিকল্পিত। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার পেছনেও এই প্রভাব রয়েছে বলে তার দাবি। এমনকি দেশের ক্ষমতা বদলের নীলনকশা আঁকতেও তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আই এস আই দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট। তসলিমা নাসরিন তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশেষত আফগানিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনায় এই সংস্থার ইতিহাস পুরনো। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আই এস আই-এর সংশ্লিষ্টতা প্রায়শই আলোচিত হয়। তসলিমা নাসরিনের অভিযোগ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে এবং ক্ষমতায় পরিবর্তন আনার জন্য আই এস আই পরিকল্পিতভাবে কাজ করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর মধ্যে একটি হলো, তিনি আই এস আই-এর সহায়তায় শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। তসলিমা নাসরিনের দাবি অনুযায়ী, এই ষড়যন্ত্রের জন্য যে অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছিল, তার মধ্যে ৭.৬২ মিমি বুলেটও রয়েছে। যদিও বাংলাদেশে এই ধরনের বুলেট নিষিদ্ধ, পাকিস্তানে তা অনুমোদিত। ফলে, আই এস আই-এর সরবরাহকৃত বুলেট বাংলাদেশে আনা এবং তা রাজনৈতিক হিংসায় ব্যবহৃত হওয়ার বিষয়টি সত্য বলে প্রমাণিত হলে, তা হবে চাঞ্চল্যকর।
বাংলাদেশে ক্ষমতা বদলের পরে কোটা পদ্ধতি, স্বজনপ্রীতি এবং অনভিজ্ঞতা নিয়ে নতুন প্রশাসন পরিচালিত হচ্ছে বলে তসলিমা নাসরিনের ভাষ্য। তিনি উল্লেখ করেছেন, আগের সরকারের কর্মীদের প্রতি বর্তমান সরকারের আচরণ যেনো একটি বিদ্বেষপূর্ণ প্রতিহিংসার প্রতিচ্ছবি। ম্যান্ডেলা ২৭ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করার পরও দক্ষিণ আফ্রিকায় রিকন্সিলিয়েশান প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করতেন এবং তিনি পুরনো সরকারের বিশেষজ্ঞদের সাথে পুনরায় কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান সরকার তার সম্পূর্ণ বিপরীতে কাজ করছে বলে নাসরিনের অভিযোগ। তিনি মনে করেন, শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে যাদের বরখাস্ত করা হয়েছে, তা জাতীয় উন্নয়নের পথে বড় বাধা হতে পারে।
তসলিমা নাসরিনের লেখায় উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে রয়েছে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের প্রসঙ্গ। তসলিমার ভাষায়, ইউনুস বাংলাদেশের মডারেট মুসলিমদের প্রতীক হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত। কিন্তু তার এই পরিচয় কতটা টেকসই, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। ইউনুসের প্রতি বর্তমান সরকারের তীব্র সমালোচনার মধ্যে তাঁর আন্তর্জাতিক সম্মান, বিশেষত নোবেল পুরস্কার, বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
তসলিমার ভাষ্যমতে, ইউনুসকে সামনে রেখে বাংলাদেশের মডারেট মুসলিম পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এর পেছনে থাকা ইসলামিস্টদের পরিকল্পনা ভবিষ্যতে বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে বলে তিনি মনে করেন। যদি এই পরিকল্পনা সফল হয়, তাহলে বাংলাদেশ হয়তো আফগানিস্তানের মতো একটি ধর্মীয় মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।
তসলিমা নাসরিনের লেখায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। তাঁর অভিযোগ, বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি উদাসীন এবং আগের সরকারের সময়কার অনেক অর্জনকে গুরুত্ব না দিয়ে একধরনের বিভাজনমূলক রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি এবং সেখানে ঘটে যাওয়া ইতিহাসের প্রতি সরকারের অবহেলা, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্যের অমর্যাদা, এসবই একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের অংশ বলে তিনি মনে করেন। তসলিমা মনে করেন, এই অবহেলার ফলে দেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবমাননা করা হচ্ছে।
তসলিমা নাসরিনের লেখায় উল্লিখিত বিষয়গুলো বাংলাদেশে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। তাঁর অভিযোগগুলো শুধুমাত্র ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও স্বাধীনতার সুরক্ষা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। তারেক রহমান ও আই এস আই-এর ষড়যন্ত্রের বিষয়টি নিয়ে দেশের রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। এ ছাড়া ইউনুস ও মডারেট মুসলিম পরিচয় নিয়ে তাঁর মন্তব্য, ক্ষমতার পালাবদল ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলা—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তসলিমা নাসরিনের লেখাটি তাৎপর্যপূর্ণ।