কলকাতা, ২২ অগাস্ট,২০২৪: পশ্চিমবঙ্গের আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সাম্প্রতিক ঘটনার জেরে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। চিকিৎসক এবং যুব সমাজের ভূমিকা নিয়ে শুরু হওয়া এই আন্দোলন এখন একটি বড় রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে, বিরোধী দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ইন্ডিয়া (INDIA) জোটের শরিকদের মধ্যে এই ইস্যুতে ভিন্নমত প্রকাশ দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই মতবিরোধ কেবল রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতিফলনই নয়, বরং ভবিষ্যতের ভোটব্যাংক এবং ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনাও এর পেছনে রয়েছে।
এ ধরনের গুরুতর পরিস্থিতিতে ইন্ডিয়া জোটের শরিক দলগুলির প্রতিক্রিয়া পরস্পরবিরোধী হয়েছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, যিনি বরাবরই নারী ও যুব সমাজের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার, তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি কঠোর সমালোচনা করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরতি জেরথ মনে করেন, রাহুল গান্ধীর এই সমালোচনার পেছনে স্পষ্ট একটি ভোটব্যাংকের কৌশল রয়েছে। তিনি বলেন, “রাহুল জানেন, নারী এবং যুব সমাজ তার সম্ভাব্য ভোটদাতা। তারা এই আন্দোলনের একটি বড় অংশ। তাই এই ঘটনার সঙ্গে যুক্তদের ক্ষুব্ধ করা তার জন্য একটি বড় ঝুঁকি।”
তৃণমূল কংগ্রেসের সমালোচনায় কেবল কংগ্রেস নয়, ইন্ডিয়া জোটের অন্যান্য শরিক দল যেমন সমাজবাদী পার্টি এবং আম আদমি পার্টি (আপ) নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করেছে। তবে তাদের প্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে সংযত ছিল। সমাজবাদী পার্টি এবং আপের এই আচরণের পেছনেও রয়েছে নির্দিষ্ট কারণ। আরতি জেরথের মতে, “এই দলগুলো জানে যে, ঘটনার প্রকৃত সত্য ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। তাই তারা এখনই চূড়ান্ত অবস্থান নিতে চাইছে না, বরং জল মাপছে।”
আরজি করের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের ভিন্নমত রাজ্য সরকারের তৎপরতা ও সিদ্ধান্তের ব্যর্থতার ফল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। আরতি জেরথের মতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি প্রথম দিনেই আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করে নিরপেক্ষ তদন্তের নির্দেশ দিতেন, তাহলে বিরোধী এবং শরিকদের সমালোচনা এড়ানো সম্ভব হতো। তিনি বলেন, “অনেক কিছুই এড়াতে পারতেন মুখ্যমন্ত্রী। যেভাবে পুরো বিষয়টাকে পরিচালনা হচ্ছে সেটা ভালো নয়। যদি প্রথম দিনেই তিনি হাসপাতালের অধ্যক্ষকে সাসপেন্ড করে নিরপেক্ষ তদন্তের কথা বলতেন, তাহলে বিরোধী বা অন্দরমহলের কটাক্ষ এড়ানো যেত।”
এই ধরনের ঘটনায় সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ায় যে রাজনৈতিক ক্ষতি হতে পারে, সেটি আরতি জেরথের বক্তব্যে স্পষ্ট। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে শক্ত অবস্থান ধরে রাখলেও, এই ধরনের পরিস্থিতিতে দেরি করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। এর ফলে বিরোধী দলগুলো সহজেই রাজনৈতিক মাইলেজ নিতে পারে।
ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের ভিন্নমতের বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। একদিকে, কংগ্রেসের মতো দলগুলি যেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের উপর চাপ বাড়াতে চায়, অন্যদিকে সমাজবাদী পার্টি এবং আপের মতো দলগুলি নিজেদের অবস্থান সংযত রেখে অপেক্ষা করছে। এই ভিন্নমতের মধ্যেই জোটের ভবিষ্যৎ ও রাজনৈতিক সমীকরণ নির্ধারণ হতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইন্ডিয়া জোটের মধ্যে এই ধরনের মতবিরোধ কেবল এই ঘটনার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি ভবিষ্যতে নির্বাচনী কৌশল এবং জোটের ভাঙন বা সংহতির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, এবং আপের মধ্যে সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি এখন থেকে জটিল হয়ে উঠতে পারে।
এই ঘটনার জেরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। একদিকে, তাকে এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে, অন্যদিকে ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের আস্থা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জও রয়েছে। কেবলমাত্র দ্রুত এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেই তিনি এই সমস্যার সমাধান করতে পারেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
আরজি করের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এবং ইন্ডিয়া জোটের ভেতরে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, তা ভবিষ্যতে কীভাবে গতি পায় সেটাই এখন দেখার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বের দক্ষতা এবং কৌশলী সিদ্ধান্ত এই সংকট থেকে রেহাই দিতে পারে কি না, তা সময়ই বলবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একমত যে, ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের ভিন্নমত এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদক্ষেপে এই ঘটনায় রাজনীতির ছাপ স্পষ্ট। তবে এই ভিন্নমতের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে ইন্ডিয়া জোটের একতা এবং তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য রাজনীতিতে অবস্থানের ওপর কী প্রভাব ফেলে, তা আগাম বলাও এখনই সম্ভব নয়। রাজনীতি যেমন তীব্র, তেমনই পরিবর্তনশীল—যা আজ একটি বিষয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছে, কাল সেই দ্বন্দ্ব আবার একতায় পরিণত হতে পারে।