শিলিগুড়িতে বিহারী যুবকদের হেনস্থা: বাংলা পক্ষের ভূমিকার গভীর পর্যালোচনা

শ্যামল রং: সম্প্রতি শিলিগুড়িতে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনায় দুই যুবক, যারা বিহার থেকে এসে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিলেন, তাদের হেনস্থা করার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় দু’জন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং শিলিগুড়ি মহকুমা আদালতে পেশ করা হয়েছে। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এই দুই যুবককে হেনস্থার পিছনে 'বাংলা পক্ষ' নামে এক সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।


'বাংলা পক্ষ' একটি আঞ্চলিক সংগঠন, যারা বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি এবং পরিচিতি রক্ষার উদ্দেশ্যে কাজ করে। তাদের মূল দাবি হল, বাংলায় বসবাসরত মানুষের পরিচিতি এবং অধিকার সুরক্ষিত করা, বিশেষ করে বাংলার বাইরে থেকে আসা মানুষদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। এই সংগঠনটি মূলত বাংলার ভূমিপুত্রদের জন্য কাজের সুযোগ সংরক্ষণ, ভাষার মান্যতা, এবং আঞ্চলিক স্বার্থের পক্ষে সওয়াল করে। কিন্তু সম্প্রতি তারা বিভিন্ন আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সংবাদ শিরোনামে এসেছে, যার মধ্যে অন্যতম হল শিলিগুড়ির এই ঘটনাটি।

শিলিগুড়ির ঘটনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হল দুটি বিহারি যুবককে বাংলা পক্ষের কয়েকজন সদস্য হেনস্থা করে, যা প্রশ্ন তোলে যে, এই ধরনের আঞ্চলিক সংগঠনের কার্যকলাপ কতটা ন্যায়সঙ্গত। ভারতবর্ষ একটি বহুজাতিক ও বহুভাষী দেশ, যেখানে প্রতিটি মানুষকে স্বাধীনভাবে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাওয়ার ও সেখানে কাজ করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু এই ঘটনার মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, বাংলা পক্ষের মতো কিছু আঞ্চলিক সংগঠন এই মূলে আঘাত করছে, যা আদতে ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

এই প্রবন্ধের মূল প্রশ্ন হল, বাংলা পক্ষ যেভাবে বাংলায় বাইরের রাজ্য থেকে আসা মানুষদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাচ্ছে, তারা কি আদৌ বাংলার বেকার যুবকদের জন্য পর্যাপ্ত কাজের সংস্থান করতে পারবে? ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এবং বিদেশে অসংখ্য বাঙালি কাজের সন্ধানে পাড়ি জমাচ্ছেন। তারা ফিরে এসে কি বাংলায় একই রকম বেতন বা কাজের সুযোগ পেতে পারেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়। 

বর্তমানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলা পক্ষ বা অন্য কোনো আঞ্চলিক সংগঠনের পক্ষে সারা দেশের বা বিদেশে কর্মরত বাঙালিদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করা কার্যত অসম্ভব। যদিও এই ধরনের আঞ্চলিক আন্দোলনগুলি ভাষা ও সংস্কৃতির সংরক্ষণে সহায়ক হতে পারে, তবে কাজের সংস্থান একটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরের ইস্যু। শুধুমাত্র আঞ্চলিক পরিচিতির ভিত্তিতে কাজের সুযোগ সীমাবদ্ধ করা বা বাইরের লোকেদের অবাঞ্ছিতভাবে হেনস্থা করা বাস্তবে কোনো সমস্যার সমাধান নয়। 

বাংলা পক্ষের আন্দোলন যে মূল সমস্যাটিকে উপেক্ষা করছে, তা হল বাংলায় কাজের সুযোগের অভাব। অনেক বাঙালি যুবক-যুবতী রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র কাজ খুঁজতে বাধ্য হচ্ছেন, কারণ রাজ্যে পর্যাপ্ত শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। কলকাতা ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলো কিছুটা শিল্পোন্নত হলেও, বাংলার গ্রামীণ এলাকাগুলিতে কাজের সুযোগের অভাব গভীর সমস্যার সৃষ্টি করছে। ফলস্বরূপ, উচ্চশিক্ষিত যুবক-যুবতীরা অন্যান্য রাজ্য বা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।

বাংলা পক্ষ যদি সত্যিই বাংলার মানুষের জন্য কাজ করতে চায়, তাহলে তাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত বাংলার অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের উন্নতি নিশ্চিত করা। রাজ্য সরকারের সাথে সহযোগিতা করে নতুন শিল্প এবং ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি করা, শিক্ষিত যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নতুন উদ্ভাবনী কাজের সুযোগ তৈরি করা—এই ধরনের পদক্ষেপগুলোই বাংলার যুবকদের রাজ্যের মধ্যে কাজ করার সুযোগ দিতে পারে।

এছাড়াও, বাইরের রাজ্য থেকে আসা মানুষদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড বাংলার সামগ্রিক ভাবমূর্তির ক্ষতি করে। বাংলার ঐতিহ্যগত সংস্কৃতিতে সবসময় অতিথিদের সম্মান জানানোর ঐতিহ্য ছিল, আর সেই ঐতিহ্যকেই রক্ষা করা উচিত। বেকারত্ব বা কাজের সংকটের সমাধান আঞ্চলিকতা বা বিভাজনের মাধ্যমে করা সম্ভব নয়, বরং দরকার উদ্ভাবনী এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পদক্ষেপ।

শিলিগুড়ির ঘটনাটি শুধু আঞ্চলিক সংগঠনগুলির কর্মকাণ্ডের ওপরই প্রশ্ন তোলে না, বরং বাংলার অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের সমস্যাগুলিকেও সামনে আনে। বাংলা পক্ষের মতো সংগঠনগুলি যদি সত্যিই বাংলার মানুষের জন্য কাজ করতে চায়, তাহলে তাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত রাজ্যের যুবকদের জন্য পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং বাইরের মানুষদের প্রতি বিদ্বেষী না হয়ে, আন্তঃরাজ্য সম্পর্ককে সম্মান করা। 

Shyamal Kumar Rong

আমি মনসুকা খবরের সাংবাদিক। খবর, ভিডিও, তথ্য, গল্প পাঠাতে যোগাযোগ করুন। ফোন/হোয়াটসঅ্যাপ ৯৭৭৫৭৩২৫২৫.

নবীনতর পূর্বতন

বিজ্ঞাপন

Mansuka khabar

বিজ্ঞাপন

Mansuka khabar
Mansuka khabar