শ্যামল রং, ৩ সেপ্টেম্বর: পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় মঙ্গলবার এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপে ‘ধর্ষণ বিরোধী বিল, ২০২৪’ পাস হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে 'অপরাজিতা নারী ও শিশু বিল (পশ্চিমবঙ্গ ফৌজদারি আইন এবং সংশোধন) বিল ২০২৪' শিরোনামে বিলটি রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক দ্বারা প্রবর্তিত হয় এবং এটি আগামী ৫ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হবে। এই আইনের মাধ্যমে নারী ও শিশুদের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে ধর্ষণ ও যৌন অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান আনা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা অনুযায়ী, দুদিনের বিশেষ অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে বিলটি পাশ হয়।
নতুন আইনে বলা হয়েছে, ধর্ষণের ফলে যদি ভিকটিমের মৃত্যু হয়, তবে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির জন্য মৃত্যুদণ্ড বাধ্যতামূলক। এ আইন শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জন্য প্রযোজ্য হবে বলে সূত্রের খবর। পূর্বের আইনে অপরাধীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান ছিল। কিন্তু নতুন সংশোধনীতে আমৃত্যু কারাবাস ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া, ধর্ষণের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হলে ঘটনার ১০ দিনের মধ্যে ফাঁসি কার্যকর করার কথাও বলা হয়েছে। আইনটি কার্যকর হলে পশ্চিমবঙ্গ হবে ভারতের প্রথম রাজ্য যেখানে ধর্ষণের জন্য এমন কঠোর শাস্তি কার্যকর হবে।
এই বিশেষ অধিবেশনটি আহ্বান করা হয়েছিল আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে একজন মহিলা ডাক্তারকে নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার পর সৃষ্ট জনরোষের পরিপ্রেক্ষিতে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জনগণের চাপে এই বিশেষ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন এবং দুদিনের এই অধিবেশনকে বিশেষভাবে ধর্ষণ বিরোধী বিলের ওপরই কেন্দ্রীভূত করা হয়।
বিশেষ অধিবেশনের প্রথম দিন থেকেই বিধানসভায় উত্তেজনা তুঙ্গে ছিল। বিরোধী দলগুলি সরকারের অবস্থান ও বিলের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “আমাদের সরকারের লক্ষ্য নারী ও শিশুদের সুরক্ষা জোরদার করা। অপরাধীদের কঠোরতম শাস্তি প্রদান করতে আমরা বদ্ধপরিকর।”
১. মৃত্যুদণ্ডের বাধ্যবাধকতা: ধর্ষণের ফলে ভিকটিমের মৃত্যু ঘটলে মৃত্যুদণ্ড বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
২. দ্রুত বিচার: ধর্ষণ মামলাগুলি দ্রুত নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে ১০ দিনের মধ্যে বিচার ও রায় প্রদান নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
৩. পুলিশের দায়বদ্ধতা: ধর্ষণের মামলা নথিভুক্ত করতে ব্যর্থ পুলিশ কর্মীদের বরখাস্ত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
৪. নিপীড়নের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি: নারী ও শিশুর ওপর অত্যাচার এবং নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে আমৃত্যু কারাবাস ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
৫. সমাজে বার্তা: সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই আইনের মাধ্যমে অপরাধীদের মধ্যে এক ভয় এবং নারীদের মধ্যে নিরাপত্তার বার্তা পৌঁছানোই মুখ্য উদ্দেশ্য।
আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক বলেন, “আমরা চাইনি এই ধরনের কঠোর আইন প্রবর্তন করতে। কিন্তু আরজি কর মেডিকেল কলেজের ঘটনাটি আমাদের বাধ্য করেছে। সমাজের এই ধরনের ঘৃণ্য অপরাধীদের জন্য ক্ষমার কোনও জায়গা নেই।” তিনি আরও বলেন, “এই বিলের মাধ্যমে অপরাধীদের কঠোরতম শাস্তি প্রদান করা হবে এবং বিচার ব্যবস্থার দ্রুততার মাধ্যমে ভিকটিমদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।”
বিল পাস হওয়ার পরপরই সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। মানবাধিকার কর্মীরা একে সমাজের প্রতি কঠোর বার্তা হিসেবে অভিহিত করলেও কিছু সংগঠন মৃত্যুদণ্ডের বাধ্যতামূলক প্রয়োগ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। তারা বলছেন, এতে বিচার ব্যবস্থার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
তবে অনেকেই এই পদক্ষেপকে একটি সাহসী এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন। বিশেষ করে আরজি কর মেডিকেল কলেজের ঘটনার পর রাজ্যের মহিলাদের মধ্যে সুরক্ষা নিয়ে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল, এই আইন তা দূর করতে সাহায্য করবে বলে মনে করছেন তারা।
বিরোধী দল বিজেপি, সিপিআইএম এবং কংগ্রেস এই বিলের বিরুদ্ধে সরব হয়। বিজেপি বিধায়ক শঙ্কুদেব পণ্ডা বলেন, “আইন পাস করে সমস্যার সমাধান হবে না। পুলিশের দায়বদ্ধতা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা এবং ত্বরিত বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই মূল চ্যালেঞ্জ।” সিপিআইএম নেত্রী সুজন চক্রবর্তী বলেন, “এই বিল শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ার। বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে, তা সময়ই বলবে।”
বিরোধীদের সমালোচনার উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমরা জনগণের স্বার্থে কাজ করছি। আইন তৈরি করা মানে এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করা। আমাদের প্রশাসন সদা প্রস্তুত এবং আমরা নিশ্চিতভাবে এই আইন কার্যকর করব।” তিনি আরও জানান, নারীর সুরক্ষার বিষয়ে কোনও আপস করা হবে না।
এই বিল পাসের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যের আইন ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। এখন দেখার বিষয়, নতুন এই আইন বাস্তব ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর হয় এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণে কতটা সক্ষম হয়।