শ্যামল রং, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪: আর জি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক মহিলা চিকিৎসকের নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্ষণ ও নারীর ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর আইন আনার কথা বলেন। তবে এর আগে রাজ্যের আন্দোলনকারীরা যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ দাবি করছিলেন, তখন তিনি শক্ত হাতে আন্দোলন দমন করেছিলেন। আর আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পদত্যাগ দাবি করছেন। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে, ভারতের আইন কি ধর্ষণের বিরুদ্ধে যথেষ্ট কঠোর নয়? ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা কি শুধুমাত্র আইনের অভাবে ঘটছে?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি এক সভায় বলেন, “দেশজুড়ে নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ধর্ষণ, হত্যা এবং অন্যান্য সহিংস অপরাধ প্রতিরোধে আমাদের আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কেন্দ্রকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে নতুন আইন আনতে হবে, যাতে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা হয় এবং দোষীরা কঠোর শাস্তি পায়।” মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্য সেই সময়েই আসে যখন রাজ্যের হাসপাতালের ভেতরে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
ভারতের ধর্ষণবিরোধী আইনগুলি বেশ শক্তিশালী হলেও এই ধরনের ঘটনা থেমে নেই। ভারতীয় দণ্ডবিধির (আইপিসি) ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী, কোনো নারীর সম্মতির বিরুদ্ধে বা প্রতারণা করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা হলে তা ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই আইনের আওতায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে, যার মধ্যে কারাদণ্ড, জরিমানা, এবং নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়াও ২০১৩ সালে দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের পর আইনগুলো আরও কঠোর করা হয়। আইপিসি ৩৭৬ ধারা অনুসারে ধর্ষণের জন্য ২০ বছর থেকে আজীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে এবং একাধিক অপরাধের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে।
কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যে যেভাবে আইনটি পরিবর্তনের দাবি তোলা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে তিনি মনে করেন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে বর্তমান আইনি কাঠামো যথেষ্ট নয়। তিনি আরও দ্রুত বিচার ও শাস্তি কার্যকর করার ব্যবস্থা চান।
আর জি কর হাসপাতালের ঘটনাটি সামনে আসার পরপরই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সাধারণ মানুষ, এবং আন্দোলনকারীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ দাবি করতে শুরু করেন। তাদের অভিযোগ, রাজ্যে অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সরকার এই বিষয়গুলি রোধে ব্যর্থ হচ্ছে। আন্দোলনকারীরা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং তার সরকারের ব্যর্থতাকে তুলে ধরেন।
এই সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আন্দোলনকে দমাতে কঠোর পদক্ষেপ নেন। পুলিশ প্রশাসনকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন এবং বহুজনকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি স্পষ্টভাবে জানান, “আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। রাজ্য সরকার আইন অনুযায়ী অপরাধীদের শাস্তি দেবে, কিন্তু কেউ আইন-শৃঙ্খলা ভাঙলে তাকে বরদাস্ত করা হবে না।”
বর্তমান পরিস্থিতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়েছে। এবার তিনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। তিনি বলেন, “দেশজুড়ে যেভাবে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে, তাতে প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকার নৈতিক অধিকার নেই। দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত।”
মমতার এই মন্তব্যের পেছনে মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অনেকের মতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই মুহূর্তে নিজেকে ‘নারী সুরক্ষার যোদ্ধা’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন। এটি আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি কৌশলও হতে পারে, যেখানে তিনি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিচ্ছেন এবং নিজেকে জনগণের পক্ষে দাঁড় করাচ্ছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বক্তব্য একটি রাজনৈতিক চাল। একদিকে নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করা এবং অন্যদিকে কেন্দ্রকে চাপের মুখে ফেলাই এর উদ্দেশ্য। তবে অনেকেই মনে করেন, এ ধরনের কৌশল ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। যেহেতু ধর্ষণ এবং নারীর ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে ভারতের আইনি কাঠামো যথেষ্ট শক্তিশালী, তাই নতুন আইন আনার দাবি কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
রাজ্যের নাগরিকরা অবশ্য মমতার এই অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। কেউ কেউ মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রী তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে চিন্তিত এবং তার দাবি যথার্থ। আবার অনেকেই মনে করেন, নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন।
আর জি কর হাসপাতালের ঘটনা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আইন আনার দাবি ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতিকে নতুন আলোকে তুলে ধরেছে। তবে আইনের বাইরে সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা কতটা সুনিশ্চিত হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।