মনসুকা খবর, নিউজ ডেস্ক: প্রায় ৩৫ বছর আগে এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে এক সাহসী কলম গর্জে উঠেছিল। সেই কলমের ডগায় উচ্চারিত হয়েছিল এক কঠিন সত্য – নারীর যৌন স্বাধীনতা। সেই সময়ে, কূপমণ্ডূক পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, তসলিমা নাসরিন তাঁর সাহিত্যকর্মে তুলে ধরেছিলেন নারীর নিজস্ব শরীর ও যৌনতার উপর অধিকারের কথা। সেই দুঃসাহসিক উচ্চারণ তাঁকে সমাজের কট্টরপন্থী, নারীবিদ্বেষী গোষ্ঠীর প্রবল রোষানলে ফেলেছিল। সহ্য করতে হয়েছিল অকথ্য কুৎসা, শারীরিক হেনস্থার হুমকি এবং নির্বাসনের যন্ত্রণা।
অথচ কালের স্রোতে আজ সেই একই বার্তা, সেই একই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে সমাজের বুকে। রাজপথ আজ মুখরিত সেইসব নারীকণ্ঠে, যাঁরা পোস্টার হাতে, স্লোগানে নিজেদের যৌন অধিকারের দাবিতে সোচ্চার। দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভ যেন আজ বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসছে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে, নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে এক গভীর উপলব্ধি ও বেদনার কথা লিখেছেন। তিনি স্মরণ করেছেন সেই নিঃসঙ্গ দিনগুলোর কথা, যখন তিনি একা দাঁড়িয়েছিলেন এই বিপ্লবের পতাকা হাতে।
তসলিমা নাসরিন তাঁর পোস্টে লিখেছেন, "বাংলাদেশের মতো দেশে বসে এই কথাটা ৩৫ বছর আগে আমি আমার বইয়ে লিখেছিলাম। আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলতে চেয়েছিল নারীবিদ্বেষী, বর্বর পুরুষ গোষ্ঠী। আজ নারীরা পোস্টারে সেই স্বাধীনতার কথা লিখে রাস্তায় র্যালি করছে। আজ র্যালিতে যোগ দেওয়ার অনেক মানুষ আছে। আমি যখন বলেছিলাম মেয়েদের যৌন স্বাধীনতার কথা, আমি একা ছিলাম। অসহিষ্ণুদের ছুড়ে দেওয়া ইট পাথর একা আমার গায়ে পড়েছিল।" তাঁর এই কথাগুলোতে একদিকে যেমন রয়েছে দীর্ঘদিনের চাপা কষ্ট, তেমনই রয়েছে আজকের নারীদের সম্মিলিত উত্থানে এক গভীর তৃপ্তি ও আশার আলো।
লেখিকা গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন যে, কেবল নারী শিক্ষা অথবা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা নারীর প্রকৃত মুক্তি এনে দিতে পারে না। তাঁর মতে, নারীর পায়ে যে শৃঙ্খলটি সবচেয়ে শক্ত করে বাঁধা, সেটি হল যৌন দাসত্বের শৃঙ্খল। এই অদৃশ্য অথচ কঠিন বন্ধন যতক্ষণ না ছিন্ন হচ্ছে, ততক্ষণ নারীর মুক্তি অধরা থেকে যাবে। তিনি জোরের সঙ্গে বলেছেন, "নারীর যে শৃঙ্খলটি সবচেয়ে শক্ত, সেটি যৌন দাসত্বের শৃঙ্খল। ওটি ছিঁড়তে হবে।"
তবে যৌন স্বাধীনতার ধারণাটিকে সমাজের একাংশ ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে বলে তিনি মনে করেন। তাঁদের ভ্রান্ত ধারণাকে স্পষ্ট করে তসলিমা লিখেছেন, "যৌন স্বাধীনতা মানেই, লোকে মনে করে, যার তার সঙ্গে শুয়ে বেড়ানো। তারা ভুল মনে করে।। যৌন সম্পর্কে হ্যাঁ বলা যেমন যৌন স্বাধীনতা, যৌন সম্পর্কে না বলাও তেমন যৌন স্বাধীনতা।" তাঁর এই সরল অথচ গভীর বক্তব্য যৌন স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থকে উন্মোচিত করে। এটি কেবল যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে পছন্দের অধিকার নয়, বরং নিজের শরীরের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অধিকার।
তসলিমা আরও বিস্তৃতভাবে যৌন স্বাধীনতার সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, "যৌন স্বাধীনতা মানে আরও অনেক কিছু, আমি কার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করবো, তার সিদ্ধান্ত আমি নেব, আমি আমার জরায়ুতে কটি সন্তান নেব, অথবা আদৌ নেব কিনা, সেটির সিদ্ধান্তও আমি নেব। এর নাম যৌন স্বাধীনতা।" এই প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একজন নারীর জন্মগত। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোয় এই মৌলিক অধিকারগুলি প্রায়শই কেড়ে নেওয়া হয়। নারীর শরীরকে দেখা হয় পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে, যেখানে নারীর নিজস্ব ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কোনও মূল্য থাকে না।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গভীরে প্রোথিত এই অন্যায় ব্যবস্থার স্বরূপ উন্মোচন করে তসলিমা বলেছেন, "পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোনও মেয়েরই যৌন স্বাধীনতা নেই।" তিনি সমাজের সেই দুই শ্রেণির নারীর করুণ অবস্থার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, যাঁরা যৌন দাসত্বের কঠিন শৃঙ্খলে সবচেয়ে বেশি বন্দি – পতিতালয়ের মেয়েরা এবং তথাকথিত গৃহবধুরা। পতিতালয়ের নারীরা যেমন অর্থের বিনিময়ে তাঁদের শরীর বিক্রি করতে বাধ্য হন, তেমনই অনেক গৃহবধূ স্বামীর ইচ্ছার কাছে নিজেদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন। উভয়ের ক্ষেত্রেই তাঁদের নিজস্ব যৌন ইচ্ছার কোনও স্বীকৃতি থাকে না। এটিই হল যৌন দাসত্বের প্রকট রূপ, যা তসলিমা বহু বছর আগে চিহ্নিত করেছিলেন এবং আজও সমাজের একটি জ্বলন্ত সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান।
আজ যখন বাংলাদেশের নারীরা রাস্তায় নেমে নিজেদের যৌন অধিকারের দাবিতে গর্জে উঠছেন, তখন তসলিমা নাসরিনের সেই বহু বছর আগের একাকী লড়াই যেন একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। তাঁর সেই সময়ের সাহসী উচ্চারণ আজ একটি সম্মিলিত আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে। সময়ের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে, তাঁর সেই উপলব্ধি আজ সমাজের বৃহত্তর অংশে স্বীকৃতি লাভ করছে। হয়তো সেই কারণেই আজ রাজপথে এত মানুষের সমাগম, এত দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।
তসলিমা নাসরিনের এই পোস্টটি কেবল একজন লেখকের ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ নয়, এটি সেইসব নারীদের প্রতিধ্বনি, যাঁরা যুগ যুগ ধরে নিজেদের যৌন অধিকারের জন্য নীরবে সংগ্রাম করে এসেছেন। তাঁর এই লেখা আমাদের সমাজের গভীরে প্রোথিত লিঙ্গবৈষম্য এবং নারীর প্রতি পুরুষের আধিপত্যবাদী মানসিকতার দিকে আঙুল তোলে। একইসঙ্গে, এটি সেই সাহসী নারীদের কুর্নিশ জানায়, যাঁরা আজ ভয়কে জয় করে রাস্তায় নেমে এসেছেন এবং নিজেদের অধিকারের কথা সগর্বে ঘোষণা করছেন।
এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন ঘটছে। হয়তো একদিন সেই সমাজ নির্মিত হবে, যেখানে প্রতিটি নারী তার শরীর ও যৌনতা সম্পর্কে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার পাবে। তসলিমা নাসরিনের মতো সাহসী নারীদের দীর্ঘদিনের লড়াই এবং আজকের প্রজন্মের নারীদের সম্মিলিত কণ্ঠ সেই ভবিষ্যতের দিকেই ইঙ্গিত দেয়। তাঁদের এই সংগ্রাম শুধুমাত্র একটি দেশের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বিশ্বজুড়ে নারীর মুক্তি আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।