ঘাটাল, মনসুকা খবর,২০২৫: যখন বয়স মাত্র ১৪ বছর ৩২ দিন, তখন বেশিরভাগ কিশোর স্কুলের পড়াশোনা, খেলাধুলা আর বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু বিহারের সমস্তিপুরের কৃষক পরিবারের সন্তান বৈভব সূর্যবংশী সেই বয়সেই ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) মঞ্চে তৈরি করেছেন ইতিহাস। গুজরাট টাইটান্সের বিরুদ্ধে মাত্র ৩৫ বলে সেঞ্চুরি করে তিনি শুধু রেকর্ডই ভাঙেননি, ক্রিকেট বিশ্বকে দিয়েছেন এক নতুন স্বপ্নের নাম। আইপিএলের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরির মালিক এখন এই বাঁহাতি ব্যাটার। তাঁর এই কীর্তি নিয়ে ক্রিকেট দুনিয়ায় হইচই পড়ে গেছে।
২০২৫ সালের ১৯ এপ্রিল, জয়পুরের সওয়াই মানসিং স্টেডিয়ামে লখনউ সুপার জায়ান্টসের বিরুদ্ধে আইপিএলে অভিষেক হয় বৈভবের। মাত্র ১৪ বছর ২৩ দিন বয়সে তিনি আইপিএলের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নামেন। এই রেকর্ড আগে ছিল বাংলার প্রয়াস রায় বর্মণের, যিনি ১৬ বছর ১৫৭ দিনে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে খেলেছিলেন। বৈভবের অভিষেক শুধু বয়সের জন্যই নয়, তাঁর খেলার ধরনের জন্যও স্মরণীয়। প্রথম বলেই শার্দূল ঠাকুরের অফস্টাম্পের বাইরের ডেলিভারিতে কভারের ওপর দিয়ে জায়ান্ট ছক্কা হাঁকিয়ে তিনি ঘোষণা করেন তাঁর আগমন। ২০ বলে ৩৪ রানের ঝড়ো ইনিংসে ছিল ২টি চার ও ৩টি ছক্কা। যদিও দল ২ রানে হেরে যায়, বৈভবের ব্যাটিং ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে গেঁথে যায়।
২৮ এপ্রিল, ২০২৫। গুজরাট টাইটান্সের দেওয়া ২১০ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে বৈভব যেন মাঠে নামেন ঝড় হয়ে। তৃতীয় আইপিএল ম্যাচেই তিনি তুলে নেন ৩৫ বলে সেঞ্চুরি, যা আইপিএলের ইতিহাসে দ্বিতীয় দ্রুততম। শুধু ক্রিস গেইলের ২০১৩ সালের ৩০ বলে সেঞ্চুরিই এর আগে রয়েছে। ইউসুফ পাঠানের ৩৭ বলে সেঞ্চুরির রেকর্ড ভেঙে বৈভব নতুন ইতিহাস লেখেন। ৩৮ বলে ১০১ রানের ইনিংসে ছিল ৭টি চার ও ১১টি ছক্কা। এই ১১ ছক্কা রাজস্থান রয়্যালসের কোনও ব্যাটারের এক ইনিংসে সর্বোচ্চ, যা সঞ্জু স্যামসনের ১০ ছক্কার রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়।
ইশান্ত শর্মার চতুর্থ ওভারে বৈভব একাই তুলে নেন ২৬ রান, যার মধ্যে ছিল তিনটি ছক্কা ও দুটি চার। রশিদ খান, মোহাম্মদ সিরাজের মতো তারকা বোলারদের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। ১৭ বলে ফিফটি করে তিনি এই মরশুমের দ্রুততম হাফসেঞ্চুরির রেকর্ডও গড়েন। শেষ পর্যন্ত তাঁর ঝড়ো ব্যাটিংয়ে রাজস্থান ১৫.৫ ওভারে ২১২ রান তুলে ৮ উইকেটে ম্যাচ জিতে নেয়। এই জয় দলের টানা পাঁচ ম্যাচের হার থামায় এবং প্লে-অফের সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখে। বৈভব ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন।
বৈভবের জন্ম ২৭ মার্চ, ২০১১, বিহারের সমস্তিপুর জেলার তাজপুর ব্লকের মোতিপুর গ্রামে। তাঁর বাবা সঞ্জীব সূর্যবংশী একজন কৃষক। মাত্র চার বছর বয়সে ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ দেখান বৈভব। বাবা নিজেই ছেলের প্রথম কোচ হন এবং বাড়ির কাছে প্র্যাক্টিসের জন্য একটি জায়গা তৈরি করে দেন। নয় বছর বয়সে সমস্তিপুরের ব্রজেশ ঝার ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন বৈভব। পরে পাটনার মনীশ ওঝার অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি নিজের ক্রিকেটকে আরও শাণিত করেন। এই যাত্রায় বাবা সঞ্জীব প্রতিদিন ৯০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ছেলেকে অ্যাকাডেমিতে নিয়ে যেতেন।
১২ বছর ২৮৪ দিন বয়সে, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক করেন বৈভব। তিনি বিহারের দ্বিতীয় এবং ভারতের চতুর্থ সর্বকনিষ্ঠ রঞ্জি খেলোয়াড় হন। এখন পর্যন্ত ৫টি রঞ্জি ম্যাচে ১০০ রান করেছেন, সর্বোচ্চ ৪১। ২০২৪ সালের নভেম্বরে, ১৩ বছর ২৪১ দিন বয়সে রাজস্থানের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি অভিষেক করে তিনি ভারতের সর্বকনিষ্ঠ টি-টোয়েন্টি খেলোয়াড় হন। ডিসেম্বর ২০২৪-এ বিজয় হাজারে ট্রফিতে মধ্যপ্রদেশের বিরুদ্ধে লিস্ট-এ অভিষেকে তিনি ভারতের সর্বকনিষ্ঠ লিস্ট-এ ক্রিকেটার হন।
বৈভবের সেঞ্চুরি শুধু দ্রুততম নয়, একাধিক রেকর্ডের মালিক। তিনি আইপিএলের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান, ২০০৯ সালে মনীশ পাণ্ডের ১৯ বছর ২৫৩ দিনের রেকর্ড ভেঙে। পুরুষদের টি-টোয়েন্টিতে সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরির রেকর্ডও এখন তাঁর, যা আগে ছিল বিজয় জোলের (১৮ বছর ১১৮ দিন)। তিনি আইপিএলের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়, সর্বকনিষ্ঠ ছক্কা মারার রেকর্ডধারী (আগে রিয়ান পরাগ, ১৭ বছর ১৬১ দিন) এবং সর্বকনিষ্ঠ চার মারার রেকর্ডধারী (আগে প্রয়াস রায় বর্মণ)।
বৈভবের বয়স নিয়ে কিছু সন্দেহ প্রকাশ পেয়েছে। সরকারি নথিতে তাঁর জন্মতারিখ ২৭ মার্চ, ২০১১। কিন্তু ২০২৩ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, তাঁর ১৪তম জন্মদিন ছিল ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩। এর ফলে তাঁর প্রকৃত বয়স দেড় বছর বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। তবে এই বিতর্ক তাঁর কৃতিত্বের গৌরব কিছুটাও কমাতে পারেনি। এমনকি ১৬ বছর বয়সেও এমন সেঞ্চুরি ক্রিকেট দুনিয়ায় বিরল।
বৈভবের এই ইনিংসে মুগ্ধ ক্রিকেট বিশ্ব। প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার যুবরাজ সিং সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, “১৪ বছর বয়সে তুমি কী করছ! পলক না ফেলে দুনিয়ার সেরা বোলারদের নিয়ে ছেলেখেলা করলে। বৈভব সূর্যবংশী—নামটা মনে রেখো।” পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার বাসিত আলি বলেন, “প্রথম বলে ছক্কা মারার আত্মবিশ্বাস দেখে মনে হয়, এই ছেলে অনেক দূর যাবে।” গুগলের সিইও সুন্দর পিচাইও এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, “ক্লাস এইটে পড়া ছেলেকে আইপিএল খেলতে দেখে চমকে উঠলাম!”
বৈভবের এই সাফল্য শুধু তাঁর নিজের নয়, বিহারের ক্রিকেটের জন্যও এক মাইলফলক। রাজস্থান রয়্যালস ২০২৪ সালের নভেম্বরে মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাঁকে ১.১ কোটি টাকায় দলে নিয়েছিল। এই নিলামে দিল্লি ক্যাপিটালসের সঙ্গে তুমুল প্রতিযোগিতার পর তাঁকে পায় রাজস্থান। বৈভবের আগে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৫৮ বলে সেঞ্চুরি এবং এশিয়া কাপে ১৭৬ রান করার অভিজ্ঞতা ছিল। বিহার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের রানধির বর্মা অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্টে তিনি অপরাজিত ৩৩২ রানের ইনিংস খেলেছেন। এক বছরে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে ৪৯টি সেঞ্চুরির দাবিও তাঁর নামের পাশে।
বৈভবের গল্প শুধু ক্রিকেটের নয়, স্বপ্ন আর সংগ্রামের। কৃষকের ছেলে থেকে আইপিএলের মঞ্চে বিস্ময় বালক—এই যাত্রায় তাঁর ত্যাগ, পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। তাঁর প্রিয় মটন-চিকেন ছেড়ে ক্রিকেটের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা, বাবার সঙ্গে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া—সবই তাঁর গল্পের অংশ। ক্রিকেট বিশ্ব এখন অপেক্ষায়, এই ১৪ বছরের কিশোর আর কী কী বিস্ময় উপহার দেবে।