মনসুকা খবর, নিউজ ডেক্স, ৩০ এপ্রিল ২০২৫: নদীয়ার রানাঘাটের শালবাগানের সন্ধ্যায় এক পরিচিত মুখ—'B.Ed ফুচকা দিদি'। শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন দেখা শ্রেয়সী ঘোষ আজ ফুচকা বিক্রি করেই নিজের পরিচিতি তৈরি করেছেন। সমাজের কটাক্ষ আর আর্থিক সংকটকে হার মানিয়ে শ্রেয়সী এখন রানাঘাটের গর্ব, নারীশক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আগামী ৬ মে জি বাংলার জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘দিদি নাম্বার ওয়ান’-এ দেখা যাবে এই লড়াকু নারীর জীবন কথা।
দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা শ্রেয়সীর ছোটবেলা কেটেছে রানাঘাটের শালবাগানে মামার বাড়িতে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মামার সহায়তায় পড়াশোনা করলেও এরপর নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই জুগিয়েছেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই নাচের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তাঁর। নাচ শিখিয়ে অল্প বয়সেই রোজগার করতে শুরু করেন শ্রেয়সী, যা তাঁর পড়াশোনার খরচ যোগাত।
সংস্কৃত অনার্সে স্নাতক হওয়ার পর ২০২০ সালে বি.এড পাশ করেন শ্রেয়সী। স্বপ্ন ছিল শিক্ষকতা করার। তবে রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় তাঁর সেই স্বপ্ন আটকে যায়। কিন্তু তিনি ভেঙে পড়েননি, বরং নতুন পথে লড়াই শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন।
চাকরির আশা যখন ক্ষীণ, তখন নিজেই কিছু করার ভাবনা আসে শ্রেয়সীর মনে। ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে বেশি সময় লাগেনি। একটি ঠেলাগাড়িতে শুরু করেন ফুচকার ব্যবসা, নাম দেন ‘B.Ed ফুচকা দিদি’। এই নাম তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং নতুন পেশাকে এক সূত্রে বাঁধে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় রানাঘাটের রাস্তায় তাঁর ফুচকার গাড়ি দাঁড়ায়, আর এলাকার মানুষের সন্ধ্যা মুখরিত হয়ে ওঠে তাঁর ফুচকার স্বাদে।
শুরুর দিনগুলোতে অনেক কথা শুনতে হয়েছে শ্রেয়সীকে। একজন বি.এড ডিগ্রিধারী মেয়ে ফুচকা বিক্রি করছেন—এই বিষয়টি অনেকের কাছে বিস্ময়কর ঠেকেছে, কেউ কেউ কটাক্ষও করেছেন। তবে শ্রেয়সী এসবে কান দেননি। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, "কাজে ছোট-বড় নেই, সৎ পরিশ্রমই আসল পরিচয়।" তাঁর এই মনোভাবই আজ তাঁকে সকলের কাছে প্রশংসার পাত্রী করে তুলেছে।
শুধু ফুচকা বিক্রি করাই নয়, শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গেও তাঁর নিবিড় যোগ রয়েছে। নাচের প্রতি তাঁর ভালোবাসা আজও অটুট। অবসর পেলেই ছোটদের নাচ শেখান এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। নাচ তাঁর কাছে শুধু শখ নয়, জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি মনে করেন, নাচ তাঁকে শক্তি যোগায় এবং জীবনের সব লড়াইয়ে এগিয়ে যেতে প্রেরণা দেয়।
শ্রেয়সীর জীবনকাহিনী কেবল একজন নারীর ব্যক্তিগত লড়াই নয়, এটি সমাজের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। তিনি প্রমাণ করেছেন, নারীরা কখনোই পিছিয়ে থাকে না। তাঁর এই উদ্যোগ নারী সমাজের জন্য গর্বের এবং রানাঘাটের জন্য সম্মানের। স্থানীয় বাসিন্দা প্রিয়াঙ্কা সেনের কথায়, "শ্রেয়সী দিদি আমাদের কাছে অনুপ্রেরণা। তিনি দেখিয়েছেন, স্বপ্ন ভেঙে গেলেও নতুন করে শুরু করা যায়।"
ইতিমধ্যেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে শ্রেয়সীর সংঘর্ষের কথা প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে তাঁর প্রচেষ্টার প্রশংসা করা হয়েছে। এবার জি বাংলার ‘দিদি নাম্বার ওয়ান’-এ অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাঁর গল্প আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাবে।
ভবিষ্যতে শিক্ষকতার স্বপ্ন পূরণ করতে চান শ্রেয়সী, তবে তার আগে নিজের পায়ে শক্ত করে দাঁড়াতে চান তিনি। তাঁর এই অদম্য সাহস এবং পরিশ্রম তাঁকে আরও অনেক দূর নিয়ে যাবে, এমনটাই আশা করা যায়।
শ্রেয়সী ঘোষের জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবনের সব বাধা অতিক্রম করে স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। তিনি শুধু 'ফুচকা দিদি' নন, তিনি সংগ্রামী নারীশক্তির এক উজ্জ্বল উদাহরণ।