মনসুকা খবর, নিউজ ডেক্স: শিক্ষার ক্ষেত্রে গৃহশিক্ষকতা এখন আর কেবল সহায়ক ব্যবস্থা নয়, এটি হয়ে উঠেছে একটি অপরিহার্য অঙ্গ। শহরাঞ্চলের ব্যস্ত জীবন থেকে গ্রামের শান্ত পরিবেশ—সর্বত্রই গৃহশিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রীদের সাফল্যের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছেন। মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশের পর প্রতিবছরই স্পষ্ট হয়, ভালো ফলের পিছনে স্কুলের পাশাপাশি গৃহশিক্ষকদের অবদান অনেক। তবে এই ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা কি শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতিফলন? নাকি অভিভাবকদের অতিরিক্ত প্রত্যাশা এবং প্রতিযোগিতার চাপের ফল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে গৃহশিক্ষকতার বর্তমান চিত্রের গভীরে যেতে হবে।
শহরাঞ্চলে গৃহশিক্ষকতা এখন শিক্ষার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। একজন পড়ুয়ার পিছনে গড়ে ছ’জন গৃহশিক্ষক থাকেন, কখনও তা ১০ জন পর্যন্তও পৌঁছায়। প্রতিটি শিক্ষক সাধারণত একটি নির্দিষ্ট বিষয় পড়ান এবং সপ্তাহে দু’দিন ক্লাস নেন। পড়ানোর সময় নমনীয়—সকাল, দুপুর, বিকাল বা রাত, যে কোনও সময়ে ‘ব্যাচ’ থাকতে পারে। বিষয়ভেদে শিক্ষকদের মাসিক বেতনও ভিন্ন। অঙ্ক, ভৌতবিজ্ঞান এবং জীবনবিজ্ঞানের জন্য গড়ে ৫০০-৬০০ টাকা, বাংলা ও ইতিহাসের জন্য ৩৫০-৪৫০ টাকা, ইংরেজি ও ভূগোলের জন্য ৪০০-৫০০ টাকা। তবে কিছু অভিজ্ঞ বা চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষক বিষয়পিছু ৮০০-১০০০ টাকাও নেন।
অভিভাবকদের মতে, স্কুলের পড়াশোনা শুধুমাত্র সিলেবাসের পৃষ্ঠস্থ চাহিদা মেটায়। গভীরভাবে বিষয় বোঝা, নিয়মিত অনুশীলন এবং পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতির ক্ষেত্রে গৃহশিক্ষকেরা অতিরিক্ত মনোযোগ দেন। শহরের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে ভালো ফলাফল করতে হলে গৃহশিক্ষক ছাড়া বিকল্প নেই বললেই চলে। ফলে, ব্যয়বহুল হলেও অভিভাবকদের ভরসা গৃহশিক্ষকদের ওপরই। মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশের পর অনেক ছাত্রছাত্রীর সাফল্যের পিছনে এই শিক্ষকদের অবদান স্পষ্ট হয়।
গ্রামাঞ্চলে গৃহশিক্ষকতার চিত্র কিছুটা ভিন্ন। এখানে একজন পড়ুয়ার পিছনে গড়ে দুই থেকে তিনজন শিক্ষক থাকেন। শহরের মতো এক শিক্ষক এক বিষয়ের পরিবর্তে গ্রামে একজন শিক্ষক প্রায়ই একাধিক বিষয় পড়ান। উদাহরণস্বরূপ, প্রথম শিক্ষক অঙ্ক, ভৌতবিজ্ঞান এবং জীবনবিজ্ঞান পড়ান মাসিক ৪০০ টাকায়। দ্বিতীয় শিক্ষক বাংলা, ইতিহাস এবং ভূগোল পড়ান ৩৫০ টাকায়, এবং তৃতীয় শিক্ষক ইংরেজির দায়িত্ব নেন ৩৫০ টাকায়। সপ্তাহে সাধারণত তিন দিন পড়ানো হয়।
গ্রামের স্কুলগুলিতে দীর্ঘ ছুটি, শিক্ষকের অভাব এবং সময়মতো সিলেবাস শেষ না হওয়ার সমস্যা গৃহশিক্ষকদের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে। পরীক্ষা নির্দিষ্ট সময়ে হলেও স্কুলে পড়াশোনার গতি অনিয়মিত। ফলে, গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের জন্য গৃহশিক্ষকেরা হয়ে উঠেছেন সিলেবাস শেষ করার পাশাপাশি পরীক্ষার প্রস্তুতির মূল ভরসা।
অভিভাবকদের একটি বড় অংশ মনে করেন, কেবল স্কুলের ক্লাসে নির্ভর করে ছাত্রছাত্রীরা ভালো ফল করতে পারবে না। স্কুলে শিক্ষকদের সময় সীমিত, একজন শিক্ষকের পক্ষে প্রতিটি ছাত্রের ব্যক্তিগত চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। গৃহশিক্ষকেরা এই শূন্যতা পূরণ করেন। তাঁরা ছাত্রদের দুর্বলতা চিহ্নিত করে, ব্যক্তিগতভাবে পড়াশোনায় সাহায্য করেন এবং নিয়মিত মূল্যায়নের মাধ্যমে তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়ান।
তবে এই নির্ভরতা শিক্ষাব্যবস্থার কিছু মৌলিক সমস্যাকেও তুলে ধরে। স্কুলে পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব, অনিয়মিত ক্লাস, সিলেবাস শেষ করার তাড়া এবং মানসম্পন্ন শিক্ষার ঘাটতি গৃহশিক্ষকতাকে প্রায় স্কুলের বিকল্পে পরিণত করেছে। এছাড়া, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার চাপ এবং অভিভাবকদের উচ্চ প্রত্যাশা গৃহশিক্ষকদের প্রতি নির্ভরতা আরও বাড়িয়েছে।
গৃহশিক্ষকতা ছাত্রদের আত্মবিশ্বাস বাড়ালেও, এর ব্যয় অভিভাবকদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। বিশেষত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য একাধিক গৃহশিক্ষকের খরচ বহন করা কঠিন। শহরে একজন ছাত্রের পিছনে মাসে ৩০০০-৫০০০ টাকা বা তার বেশি খরচ হতে পারে, যা অনেক পরিবারের জন্য বোঝা। গ্রামে খরচ তুলনামূলক কম হলেও, সেখানেও আর্থিক চাপ উপেক্ষণীয় নয়।
অন্যদিকে, গৃহশিক্ষকতা অনেক শিক্ষকের জন্য আয়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। বিশেষত গ্রামে, যেখানে চাকরির সুযোগ কম, গৃহশিক্ষকতা একটি সম্মানজনক পেশা হয়ে উঠেছে। তবে, এই পেশার কোনও নির্দিষ্ট কাঠামো বা নিয়ন্ত্রণ নেই। শিক্ষকদের যোগ্যতা, পড়ানোর মান এবং বেতনের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য রয়েছে।