কেন শীতকালে ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু হয়? এই মৃত্যু ঠেকাতে করণীয় কি?

শীতকাল। শ্মশানে ভীড়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে অনেকেরই। এর পিছনে নানা কারণ থাকতেই পারে। তবে স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ঘুমের মধ্যে শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যাঘাত ঘটাও বিরল কোন রোগ নয়। তবে প্রায় সময়ই আমরা এই সমস্যাটির গুরুত্ব বুঝতে পারি না। আপনার পরিবারে যদি এমন কেউ থাকে যে ঘুমের মধ্যে নাক ডাকে, সারাদিন ক্লান্ত বোধ করে, তবে এটি হতে পারে স্লিপ অ্যাপনিয়ার লক্ষণ- তার চিকিৎসার উদ্যোগ নিন আজই।


একজন স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগীর ঘুমের মধ্যে অসংখ্যবার, এমনকি ঘন্টায় ত্রিশ বা তারও বেশী বার শ্বাস প্রশ্বাস থেমে যেতে পারে, এবং প্রতিবার শ্বাস বন্ধ অবস্থার স্থায়িত্বকাল কয়েক সেকেন্ড থেকে মিনিট পর্যন্ত হতে পারে। এরপর আবার স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস শুরু হয়। এসময় নাকডাকার মত শব্দ হতে পারে। ক্রমাগত এই ব্যাঘাতের কারণে ঘুম গভীর হতে পারে না, ফলে স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগী সারাদিনই ক্লান্ত-অবসন্ন বোধ করেন। এমনকি দেহে ও মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পৌঁছার একটি কারণও হতে পারে স্লিপ অ্যাপনিয়া।


ঘুমের সময় নাক ডাকা, শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া, বারবার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ঘুম অপূর্ণ থেকে যায়। ফলে দিনের বেলায় কাজের সময় ঘুম ঘুম ভাব আসে। একেই বলে স্লিপ অ্যাপনিয়া বা নিদ্রাকালীন শ্বাসরোগ। 

এই রোগ আবার দুই ধরনের। যেমন—

অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া (OSA) : এতে রোগীর গলবিলে শ্বাস বন্ধ হয়ে নাক ডাকা ও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। শ্বাসনালীর কোথাও কোন একটি বাধার কারণে শ্বাস প্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটে। রোগী যখন জোর করে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করে তখনই নাক ডাকার আওয়াজ হয়। যে কারোরই এই সমস্যা হতে পারে তবে অতিরিক্ত ওজন, ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বড় টনসিল এ ধরণের স্লিপ অ্যাপনিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। সারা বিশ্বে সাধারণত প্রতি ১০০ জনের মধ্যে দুই থেকে চারজন ওএসএ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় ভুগে থাকে।

সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া (CSA) : এটি সাধারণত ব্রেন বা মস্তিষ্কের কারণে হয়। মস্তিষ্ক থেকে সঠিক সংকেত না পাওয়ায় শ্বাস প্রশ্বাসের মাংসপেশী মাঝে মাঝে কাজ বন্ধ করে দেয়। এর কারণে সাধারণত হার্ট ফেইলিওর, লিভার ফেইলিওরও হতে পারে। রোগীর শ্বাসকেন্দ্রে অর্থাৎ মস্তিষ্কে যে রেসপিরেটরি সেন্টার থাকে, সেখানেই শ্বাসের প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে। এটি তুলনামূলক কম হয় এবং অন্যান্য কিছু রোগ ও ওষুধের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে।

এই রোগের কারণ কি?

 ১) মুখ ও করোটির গঠনগত ত্রুটি : কিছু মানুষের বিশেষত এশিয়া অঞ্চলের মানুষের মধ্যে দেখা যায়, নিচের চোয়াল ছোট বা পেছনের দিকে চাপা, ফলে মুখগহ্বর সংকীর্ণ হয়ে যায়। এ ধরনের রোগীদের দৈহিক স্থ্থূলতা না থাকলেও স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে।

২) বয়স : ৩০ থেকে ৬৫ বছর বয়সীদের স্লিপ অ্যাপনিয়ার প্রবণতা বেশি। তবে শিশুদের, বিশেষ করে যাদের টনসিল অথবা অ্যাডিনয়েড আকারে বড় হয়, তাদেরও হতে পারে।

৩) লিঙ্গ : সাধারণত নারীদের চেয়ে পুরুষের বেশি হয়। নারীদের তুলনায় পুরুষদের স্লিপ অ্যাপনিয়ার হার দুই গুণ বেশি। তবে রজোবন্ধ বা মেনোপজের পর পুরুষ ও নারীরা সমানভাবে এই রোগে আক্রান্ত হয়। গর্ভবতী নারীরাও এই রোগে বেশি ভোগেন।

৪) ধূমপান : ধূমপানের ফলেও স্লিপ অ্যাপনিয়া হয়, যা প্রতিরোধযোগ্য।

৫) জেনেটিক বা বংশগত : হার্ট ফেইলিওর, অ্যাজমা, সিওপিডি, কিডনি ফেইলিওর, স্ট্রোক, হাইপোথাইরয়েডিজম ইত্যাদি এ রোগ বাড়িয়ে দেয়।


এই রোগের লক্ষণ গুলি কি কি?

নাক ডাকা, শ্বাস বন্ধ হওয়া, ঘুম থেকে জেগে ওঠা, রাতে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, মুখ ও গলা শুকিয়ে যাওয়া, মুখ ও গলা শুকিয়ে যাওয়া, সকালে মাথা ব্যথা, ঘুমের ঘোরে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করা, ঘুমে অতৃপ্তি, সারাদিন ব্যাপী তন্দ্রালু ভাব, অতিরিক্ত সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। এছাড়াও কর্মদক্ষতা কমে যায়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, ছোটখাটো কারণে বাসায় ও কর্মক্ষেত্রে ঝগড়াঝাঁটি লেগে যায়। অনেক ক্ষেত্রে কোন কোন পুরুষ রোগীর যৌনক্ষমতা হ্রাস পায়।

কিভাবে এই রোগ নির্ণয় করা যায়?
স্লিপ অ্যাপনিয়া চিকিৎসকের পক্ষে সনাক্ত করা কঠিন। এটি নির্ণয় করার জন্য কোন পরীক্ষা নেই, এবং যেহেতু শুধু ঘুমের মধ্যে হয়, রোগী নিজে বেশীর ভাগ সময় এ সম্পর্কে সচেতন থাকেন না। পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে শুনে বা তাদের সাহায্য নিয়ে এটি সনাক্ত করা হয়। তাই পরিবারের কারো এরকম সমস্যা হতে দেখলে উপেক্ষা করবেন না- কারণ আপনার একটু সাহায্য হয়তো একজন রোগীকে নিশ্ছিদ্র নির্বিঘ্ন ঘুম এনে দিতে পারে।

এই রোগ নির্ণয়ের জন্য গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড পদ্ধতি হলো—পলিসমনোগ্রাফি।পলিসমনোগ্রাফি পরীক্ষার সাহায্যে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় একজন রোগীর ঘুমের পর্যায়, শ্বাস-প্রশ্বাসের অবস্থা, বুকের ওঠা-নামা, নাক ডাকার অবস্থা, হৃত্স্পন্দন, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা, পায়ের নড়াচড়া ইত্যাদি পরিমাপ করা হয়।

এই রোগের ক্ষেত্রে কি কি সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত :-

স্লিপ অ্যাপনিয়া হলে রোগীদের সতর্কতা অবলম্বন করে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। যেমন—

► মাথার দিকটা উঁচু করে ডান বা বাঁ দিকে কাত হয়ে শোয়া।

► ঘুমের ওষুধ, মাংসপেশি শিথিল করার ওষুধ যথাসম্ভব পরিহার করা।

► ধূমপান ত্যাগ করা।
► অতিরিক্ত ওজন কমানো।

► যদি নাক বন্ধ থাকে, তবে ফ্লুটিকাসন নেজাল স্প্রে ব্যবহার করা বা চিকিৎসা করা।

যাদের ওজন বেশি, তাদের স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এছাড়া যদি ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হাইপোথায়রায়ডিজম—এসব রোগ থাকে, তবে স্লিপ অ্যাপনিয়ার আশঙ্কা বাড়ে। স্লিপ অ্যাপনিয়ার চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী ও ধৈর্য সাপেক্ষ। লাইফস্টাইলে পরিবর্তন এনে, মাউথপিস বা ব্রিদিং ডিভাইস ব্যবহার করে এবং প্রয়োজনে অপারেশন করে এটিকে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে নিরাময় করা যায়। তবে চিকিৎসা না করে ফেলে রাখা যাবে না, কারণ উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিসের মত রোগের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত ক্লান্তিভাব থেকে যে কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। CPAP, BPAP, MAD ইত্যাদি পদ্ধিতেত স্লিপ অ্যাপনিয়ার চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসার সাহায্যে গলার পেছনের টিস্যুর কিছু অংশ বা পুরোটাই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে শ্বাসনালি রুদ্ধ না হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে চোয়ালের অবস্থান সামান্য পরিবর্তন করে জিবের পেছনের ভাগে শ্বাস চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা তৈরি করা হয়।


দীর্ঘদিন স্লিপ অ্যাপনিয়ার চিকিৎসা করা না হলে ধীরে ধীরে রোগীর পালমোনারি হাইপারটেনশন হয়ে হার্টফেল করতে পারে, যাকে বলে করোপালমোনেলি।

অনিয়মিত হৃত্স্পন্দনের কারণে হঠাৎ কারো মৃত্যু হতে পারে।

এ ছাড়া ডায়াবেটিস, দেহের ওজন বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি জটিলতা দেখা দেয় স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগীদের।
( লেখক - Mr. Kajal Banerjee  সংগ্রহ )

Shyamal Kumar Rong

আমি মনসুকা খবরের এডিটর। মনসুকা খবরে আপনি যেকোনো খবর, ভিডিও, তথ্য বা গল্প আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। আপনার তথ্য আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ফোন বা হোয়াটসঅ্যাপ: ৯৭৭৫৭৩২৫২৫

নবীনতর পূর্বতন
Mansuka khabar

বিজ্ঞাপন

Mansuka khabar