সামনে পূজা ' তাই দিবস যত সম্মুখে আসিতেছে কচিকাঁচাদের অন্তরে উৎসাহের অন্ত নাই । পুজায় কোন দিবস কোন পোশাক পরিধান করিবে , তাহা লইয়া পুর্নদিবসে প্রাণচাঞ্চল অন্তরে এক-আধবার নহে সাত- সাতবার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করিতেছে । স্থান - কাল ও অর্থনৈতিক অবস্থা অনুযায়ী পূজার নতুন পোশাক কত দিবসের হইবে তা নির্ধারণ হইয়া থাকে , আরম্ভ হইতে অন্ত পর্যন্ত কাট - ছাঁট করিয়া পুজা হাতেগুনা মাত্র চারটি দিবস ।
স্বাভাবিক কারণেই পুজা দেখিবার জন্য চারটি নতুন পোশাকের প্রয়োজন হইয়া থাকে । শহরের দিকে চার ও তার অধিক পোষাক -পরিচ্ছদ আত্মীয়-পরিজনের পক্ষ হইতে উপহার স্বরূপ পাইলেও , গ্রাম ও শহরতলীর আর্থিক দুরবস্থা সম্পন্ন পরিবারের সন্তানদিগের দুই-একখানা পোশাক-পরিচ্ছদ কোন ক্রমে জোটে , তা পরিবারের তরফ হইতে ক্রয় করিয়া হোক বা আত্মীয় স্বজনদের পক্ষ হইতে উপহার প্রদান হোক , আবার প্রত্যহ বৎসর তাও জোটে নাই । ফলস্বরূপ আর্থিক দুরবস্থা সম্পন্ন পরিবারের সন্তানদিগের বাটিটা হইতে ক্রয় করিয়া নতুন পোশাকের সহিত গত পূজার ভালো পোশাক-পরিচ্ছদকে মিলাইয়া পরিধান করিতে হয় । আবার আগামী বৎসরের নিমিত্ত সযত্নে গচ্ছিত করিয়া রাখিতে হয় তোরঙ্গে। যাহাদের পক্ষে সম্ভব হয় , তাহারা এই তোরঙ্গে ন্যাপথলিন সহযোগে পোশাক পরিচ্ছদ সযত্নে রাখে , যাহাদের পক্ষে তাহাও সম্ভব নহে তাহারা কোন রকমে কোন কিছু না দিয়াই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়া তুলিয়া রাখে । পরবর্তীকালে কোন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হইলে তাহা তোরঙ্গ হইতে বাহির করিয়া পরিধান করিয়া থাকে, অনুষ্ঠান সমাপ্ত হইলে পুনরায় তা স্বযত্নে গচ্ছিত করিয়া রাখে আগামী বৎসর পরিধানের নিমিত্তে । এই প্রকার দিবসের অন্তে দিবস তৎসহ বৎসরের অন্তে বৎসর অতিবাহিত হইয়া যায়। তন্মধ্যে ভালো ভালো পোশাক পরিচ্ছদ বর্ন বৈষম্য নাম ভেদে তোলা কাপড়ে পরিনত হইত ।
এই রকম এক নিম্ন মধ্যবিত্ত আর্থিক দুরাবস্থা সম্পন্ন ব্যক্তি হইলেন কুন্তলবাবু । দুই পুত্রসন্তান তৎসহ এক দুহিতা লইয়া স্বামী স্ত্রীর পাঁচ সদস্যের সংসার । কুন্তলবাবু রাস্তার মোড় মাথায় একটি ক্ষুদ্র পান্থশালা চালান , পান্থশালাটির নাম 'মা অন্নপূর্ণা হোটেল'। এই পান্থশালাটি তেমন আহামরি চাকচিক্য ও বৃহৎ পরিসেবাময় অবস্থা নহে । রাস্তার পার্শ্ববর্তী, বাটিটা সম্মুখে শতক খানেক বহির্ভবন থাকিবার কারণে উক্ত ভূমিখন্ড পরিবেষ্টিত করিয়া দুই-চারিটি বাঁশের খুঁটি প্রথিত করা , ছাওনি সহযোগে ক্ষুদ্র একটি পান্থশালা নির্মাণ করিয়াছেন । তাহার পশ্চাতে টিনের চালা বাড়াইয়া ,পরিবারের সকলেই একত্রে কোনরকমে দিবস যাপন করেন আনন্দের সহিত । এই পান্থশালাটির উপর নির্ভর করে কুন্তলবাবুর পরিবারের অর্থনৈতিক রুজি -রোজগার , সেবন - ভক্ষন , দুহিতা - পুত্রদিগের অধ্যায়ন , পোশাক- পরিচ্ছদ , আত্মীয় - স্বজন ইত্যাদি ইত্যাদি । ফলস্বরূপ পান্থশালাটির অবস্থাগত পরিবর্তন অধিক না হইলেও , কয়েক বৎসর বয়স বৃদ্ধির সহিত প্রাথমিক অবস্থা হইতে বর্তমানে কিছুটা অবস্থার শ্রীবৃদ্ধি হইয়াছে । তবে তা চক্ষু চড়কগাছ করিবার মত নহে । বর্তমানে উনুনের পরিবর্তে গ্যাস , বেঞ্চির পরিবর্তে কেদারা ও মেজ , তালপাতার হাত পাখার পরিবর্তে মাথার উর্দ্ধে বৈদ্যুতিক পাখা তৎসহ মোটামুটি না থাকিলে নহে এমন কিছু প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বৃদ্ধি করিয়াছে । বাকি অতীতও যাহা ছিল বর্তমানেও ঠিক তেমনি রহিয়াছে ।
পান্থশালার সূচনালগ্নের শুভক্ষণ হইতেই কুন্তলবাবু নিজদিগের রন্ধনের সহিত কিছু অধিক পরিমাণ অন্ন ও ব্যঞ্জন ফুটাইয়া লইতেন , পরিবারের পাশাপাশি আর দু-দশ জনের আহারের ব্যবস্থা করিয়া । নিজদিগের রন্ধনের সহিত ব্যবসার উদ্দেশ্যে পরিপাক করিবার কারণে আপন করিয়া সুন্দর , পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রন্ধন করিতেন স্ত্রীর সহযোগিতায়। পান্থশালায় যে দু-দশ জন গ্রাহক আসিতেন সকলেই তৃপ্তি ভরিয়া আহারাদি ভক্ষন করিয়া , প্রসংশা করিয়া যাইত ।গ্রাহক সমাপ্ত হইলে বাটিকার সকলেই মধ্যাহ্নের আহার ভক্ষন করিত । পুর্নদিবসে যত গ্রাহক আসিতো তাহাদের উপর নির্ভর করিত কুন্তলবাবুর পরিবারের আর্থিক অবস্থা , এই আর্থিক অবস্থার পানে লক্ষ্য করিতে গিয়া অধিক সময় পরিবারের বড়দের আধপেটা থাকিতে হইত , কারণ গ্রাহকের বৃদ্ধি হইলে তাহাদের নিজদিগের নিমিত্তে তুলিয়া রাখা আহারাদি হইতে পরিবেশন করিতেন । এই প্রকার দিবস অতিবাহিত হইত তন্মধ্যেই ধীরে ধীরে বাটিকার ছোট ছোট সন্তান-সন্ততিরা পান্থশালার সংযুক্ত বাটিকার অন্তঃপুরে বাড়িয়া উঠিতে লাগিল ।
এইরকম এক পরিস্থিতিতে মহাষষ্ঠীর গোধূলিলগ্নে কুন্তলবাবুর একমাত্র দুহিতা মোনালিসা,বাটিকার কর্নারে শয্যার আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত তোরঙ্গ উম্মুক্ত করিয়া । তোরঙ্গের অন্দর হইতে একটি - একটি করিয়া পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের তোলা পোশাক -পরিচ্ছদ বাহির করিতেছে নিজের তোলা পোশাকের উদ্দেশ্যে ,অতি আগ্রহের সাহিত কৌতুহলী মনে পরের পর তুলিয়া বাহির করিয়া রাখিতেছে । এমতাবস্থায় মোনালিসা দেখিতে পাইল তোরঙ্গের প্রায় অন্তঃপুরে একটি স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন প্লাস্টিকের আধারের অভ্যন্তরে,খন্ড খন্ড করিয়া একটি বিদীর্ণ হাজার টাকার কাগজি মুদ্রা , যাহা লেই সহযোগে জোড়া দেওয়া অবস্থায় একটি সংবাদ পত্রের উপর সযত্নে গচ্ছিত করিয়া রাখা । তাহা দেখিয়া মোনালিসার অন্তরে কৌতূহলের অন্ত নাই । বিদীর্ণ কাগজি মুদ্রাটি হাস্তে ধারণ করিয়া ভাবিতে লাগিল পোশাক ক্রয় করিবো ,উপানৎ ক্রয় করিবো , কণ্ঠভূষণ ক্রয় করিবো, কঙ্কণ ক্রয় করিবো এই সব সাতপাঁচ ভাবিতে ভাবিতে এদিক ওদিক তাকাইয়া পরক্ষনেই উচ্চগলায় পিতাকে ডাকিয়া কহিলো --
---পিতা ' এখানে আসিয়া দ্যাখো কি পাইয়াছি ?
--- পিতা কুন্তল বাবু মোনালিসার আহ্বানে কোন রূপ আগ্রহ না দেখাইয়া বলিলেন , হস্তে একখানি কার্য করিতেছি যেথায় যাহা পাইয়াছো তাহা রাখিয়া দাও , কার্য ছাড়িয়া আমার ওখানে যাইবার ফুরসত হইবে না, রাত পোহালেই সপ্তমী, দোকান পাট ধৌত করিয়া - শুষ্ক করিতেছি চারিদিক অপরিষ্কার হইয়া পড়িয়াছে । তোমার মাতা অষ্টমীর ব্রত পালন করিবে আগামীকাল হইতেই নিরামিষ পালন হইবে।
--- তবে মাতা - কে পাঠাইয়া দাও ।
--- তোমার মাতা প্রস্থান করিতে পারিবে না , জলপাত্রে জল বহন করিয়া আমাকে সাহায্য করিতেছে ।
--- পিতা - মাতা আসিতে না পারার কারণ অনুধাবন করিয়া , ছোট মোনালিসা বিদীর্ণ কাগুজে মুদ্রা টি হস্তে লইয়া পিতার নিকট দৌড়াইয়া আসিলো । আর বলিল এই দ্যাখো আমি ইহার কথাই তোমাদিগকে বলিতে ছিলাম।
-- ও ইহার কথাই বলিতেছিলে।
-- হ্যাঁ পিতা ।
-- ইহা অক্ষত অবস্থায় , যে স্থানে অবস্থিত ছিল সে স্থানে রাখিয়া আইসো ।
--- আমার পোশাক ক্রয় করিয়া দেবেন চলুন ।
--- মুদ্রা কোথায় পাইব ?
--- এই তো , এই কাগুজে মুদ্রাটি তো আছে ।
--- আরে আমার নির্বোধ কন্যা , এই বিদীর্ণ কাগুজে মুদ্রা লইয়া তোমাকে কেহ পোশাক দেবে না ।
--- দেবে না কেনো? আপনি চলুন তো !
--- সত্যি বলিতেছি এতে কিছুই হইবে না ।
--- তাহা হইলে আপনি এটাকে রাখিয়াছেন কেন ? যে কাগুজে মুদ্রা কোন কিছু ক্রয় উপযোগী নহে , সে মুদ্রা থাকা আর না থাকা কিছুই আসে না !
--- শুনো ' এটি অতীতে একটি হাজার টাকার কাগুজে মুদ্রা ছিলো বর্তমানে মুদ্রা নহে সম্পূর্ণ কাগজে পরিনত হইলেও আমার নিকট এটি একটি ঘটনার স্মৃতি বিজড়িত গচ্ছিত সম্পদ ।
--- তাহা হইলে এটা রাখিয়াছো কেন ? ফেলিয়া দাও।
--- বলিলাম না এটি একটি সম্পদ । আর সম্পদকে কভূ ফেলিতে নাই , তাহাকে অতি যত্ন করিয়া রাখিতে হয় ।
---সম্পদ না ছাই ।
--- শোনো ইহার একটি সুন্দর ঘটনা রহিয়াছে । সেটি কর্ণগোচর করিবার অন্তে যদি মনে করো ইহা কোন সম্পদ নহে , তাহা হইলে তুমি যাহা বলিবে আমি তাহাই করিবো ।
বেশ কয়েক বৎসর পূর্বেকার ঘটনা , আমাদিগের এই পান্থশালাটি সবে মাত্র এক বৎসর হইয়াছে । আশে পাশের লোকজন ব্যাতিত বাহিরের লোকজন তেমন সচ্ছ ভাবে জানে নাই । ফলে গ্রাহক আসিতো সমগ্র দিবসে হাতে গোনা কয়েক জন মাত্র , তাও পারিপার্শ্বিক পান্থশালায় আহার না মিললে অন্যথায় আমাদিগের পান্থশালায় আহারের নিমিত্তে আসিতো । তাই সাধারণ ভাবেই আমাদিগের পান্থশালায় গ্রাহক আসিতো মধ্যাহ্ন অতিক্রান্তের পর । বৎসরের এক রৌদ্র প্রখর দিবসে মধ্যাহ্ন অতিক্রান্ত হইয়া গোধূলিলগ্ন উপস্থিত হইবার উপক্রম এমতাবস্থায় শুটেট - বুটেট , স্কন্ধে চামড়ার মূল্যবান আধার , দক্ষিণহস্তে মূল্যবান সময় যন্ত্র , চোক্ষু জুড়িয়া আতপত্রাণ পরিহিত এক ভদ্রলোক আসিয়া কহিলেন ---
--- পান্থশালায় কেহ আছেন ?
আমি তখন ভাতঘুমে অর্ধনিদ্রাগ্রস্ত , নয়ন দুখানি ঘুম - ঘুম পরিবেশে এক রকম বন্ধ থাকিলেও , কর্ণ যথারীতি অতি সক্রিয় । ভদ্রলোকের আওয়াজ কর্ণ
গহ্বরে প্রবেশ করিলেও , আমি শ্রবন না করিয়া ভনিতা করিয়া শুইয়া ছিলাম ।আমার কোন হেলদোল না দেখিয়া ভদ্রলোক পুনরায় মন্দ্রিত স্বরে বলিলেন ---
---- পান্থশালায় কেহ আছেন ?
আমি তখন আকশ্মিক নিদ্রাহীন টানটান নয়নে , ভদ্রলোকের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া বলিলাম , কি ব্যাপার ?
--- মধ্যাহ্ন ভোজনের হেতু আহারাদি পাওয়া যাইবে ?
--- না ।
--- একটু চেষ্টা করিয়া দেখুনতো ,যদি কিছু সম্ভব হয় ।
--- সত্যি বলিতেছি কোন ভাবেই হইবে না ।
--- বুঝিতে পারিতেছি অনির্দিষ্টসময় আসিয়া পড়িয়াছি , তথাপি অনুরোধ করিতেছি যদি ক্ষুধা নিবৃত্তি হইতো অতি উপকার হইতো, ইহার পরিবর্তে যত অঙ্কের মূল্য ধার্য করিবেন তাহাই প্রদান করিব।
এই বলিয়া ভদ্রলোকটি প্যান্টের পকেট হইতে বাহির করা পার্শের অন্দর হইতে একটি নতুন হাজার টাকার কাগুজে মুদ্রা বাহির করিয়া আমার উদ্দেশ্যে বাড়াইয়া , আমার গ্রহণের অপেক্ষায় থাকিলেন । আমি ভদ্রলোকটির মুখমন্ডল পানে কিছুক্ষণ দৃষ্টিপাত করিয়া ভাবিতে লাগিলাম উনি বোধহয় আমাকে অর্থের প্রলোভন দেখাইতেছেন , অথবা অর্থ প্রাচুর্যের অহংকার করিতেছেন , নয়তো সত্যই আহারের আগাম অর্থ প্রদান করিয়া অতিরিক্ত অর্থ প্রত্যর্পিত করিতে চান ।এই সব ভাবিতে ভাবিতে বলিলাম,
--- ইহা মুদ্রা হেতু নহে , যেহেতু ব্যাবস্থাপনাই নাই সেহেতু কিছুই করিবার উপায় নাই ।
--- অবশ্যই সঠিক কথা । আপনি এই পান্থশালার অধিকারী, যদি আমার মধ্যাহ্ন ভোজনের উদ্দেশ্যে আহারের ব্যাবস্থা করিয়া দিতেন তাহা হইলে অত্যন্ত হিতসাধন হইতো, তাহার নিমিত্ত যত ব্যায় হইতো তাহা তো বরাদ্দ করিতামই বরং তাহার সহিত উপযুক্ত পারিশ্রমিকও বরাদ্দ করিতাম । সেহেতু আমি ক্ষণকাল অপেক্ষা করিতেও প্রস্তুত ।
--- আপনি আমাকে এই অসময়ে পুনরায় অন্ন রন্ধন করিতে বলিতেছেন ।
--- আঞ্জে।
--- তাহা কোনো প্রকারে সম্ভব নয়, আপনি অন্যত্র অন্বেষণ করুন । আমার নিকটে পাইবেন না ।
--- অদ্য পূর্ণদিবস আহার ভক্ষন না করিয়াই এক প্রকার উপোস করিয়া রহিয়াছি , প্রাতঃকালে গৃহে চা - বিস্কুট গ্রহণ করিয়া বাহির হইয়াছি, কার্যের তাড়নায় প্রাতরাশ করা হইয়া ওঠেনাই , মধ্যাহ্ন অতিবাহিত হইতেই উদরের অন্দরে মোচড় ও বুকের অন্দরটা আই-ঢাই করিতেছে , মনে হইতেছে এইবুঝি জীবন বাহির হইয়া যাইবে , মনে হইতেছে যেন অধিক দিবস যাবৎ অন্নের সম্মুখীন হইনাই ।
--- সমস্ত বিষয় বোধগম্য করিয়া কহিতেছি সম্ভব নয়, তাহার উদ্দেশ্যে অধিক বাক্য ব্যায় করিয়া লাভ হইবে না, আপনি অন্যত্র প্রচেষ্টা করুন ।
আমার নিকট একথা শুনিয়া , ক্ষুধার্ত উদরে একথালা নিরাশা ভরিয়া ভদ্রলোক পশ্চাৎপদে ফিরিয়া , আমাদিগের পান্থশালা হইতে গমনোদ্যত হইয়াছেন । এমতাবস্থায় ভদ্রলোকটির করমন্ডলে ধারণ করা হাজার টাকার কাগুজে মুদ্রাটি দুই হস্ত দ্বারা খন্ডে খন্ডে বিদীর্ণ করিতে লাগিলেন । আমি দ্রুততার সহিত কয়েক-পা আগাইয়া ভদ্রলোকটির নিকটস্থ হইয়া বলিলাম ,
--- আপনি এ-কি করিলেন ! মুহুর্তের মধ্যেই হাজার টাকার কাগুজে মুদ্রাটি বিচ্ছিন্ন করিয়া বিদীর্ণ করিয়া ফেলিলেন । আরো দু-একটি পান্থশালায় অনুসন্ধান করিতে পারিতেন । কোন না কোন স্থানে আহারের ব্যবস্থা হইলেও হইতে পারিত ।
--- আমি সমস্ত পান্থশালায় হন্নে হইয়া কাঙ্গালীর ন্যায় অনুসন্ধান পূর্বক ঘুরিতেছিলাম , একটি বয়ষ্ক ভদ্রলোক আপনার পান্থশালার পথনির্দেশ করিয়া কহিলেন এই অবেলায় ওখানে আহারের নিমিত্ত অন্ন পাইলেও পাইতে পারেন কারণ ইহা আপনাদের পারিবারিক পাকশালা। ওনার কথা মানিয়া অফুরন্ত আশা লইয়া এখানে আসিয়া ছিলাম, তদুপরি এখানেও ক্ষুধার্ত উদরের জ্বালা হইতে নিষ্কৃতি পাইবার উপায় নাই, তাহা হইলে এই অর্থের কি মূল্য ? অর্থ থাকিয়াও একমুঠো অন্ন সংস্থান করিতে পারলাম না ।
এই বলিয়া বিচ্ছিন্ন বিদীর্ণ কাগুজে মুদ্রার খন্ড গুলি পথের মধ্যস্থলে নিক্ষেপ করিয়া বাহির হইয়া যাইতেছেন । তৎক্ষণাৎ আমি দৌড়াইয়া গিয়া ভদ্রলোকটিকে আতিথেয়তার সহিত পান্থশালার মেজে উপবেশন করাইয়া; অধিক বিনম্রতার সহিত অবহিত করিয়া কহিলাম, অদ্য আমাদিগের পল্লির সহিত আমাদিগের বাটিতেও অরন্ধন , ফলস্বরূপ রন্ধন বিরতি অতএব গতকালের পান্তাভাত পাওয়া যাইতে পারে । আপনি যদি অনুমতি করেন , তাহা হইলে আমি পরিবেশন করিতে পারি । আমার উক্ত কথা শ্রবণ করিয়া ভদ্রলোকটি ওষ্ঠের কর্নারে মৃদু হাসি আনিয়া কহিলেন যখন ক্ষুধার জ্বালায় উদরাগ্নি জ্বলে তখন তাহা নিবারণ বৃহৎ ব্যাপার , তাহা তপ্ত অন্ন সহযোগেই হোক আর পান্তাভাত সহযোগেই হোক । তৎক্ষণাৎ আমি অতি দ্রুততার সহিত পড়ি-মরি করিয়া ক্ষুধার্ত কে আহার দানের অন্ধস্নেহে বাটিকার অন্ত হইতে একটি জাম-বাটিতে করিয়া , শুধুই জলভাত আর তাহার সহিত সামান্য ভাঁজা ভুজি ও খান কয়েক কাঁচা লঙ্কা দিয়া আহারের উদ্দেশ্যে পরিবেশন করিলাম ।
ভদ্রলোকটি মনের আনন্দে তৃপ্তি করিয়া আহার করিতে লাগিলেন। আমি মানুষটির পানে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়া থাকিলাম । মনের অন্দরে হাজার চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খাইতে লাগিলো , তারপর আমি যেন কেমন করিয়া কোথায় হারাইয়া গেলাম । ভদ্রলোকটি আহার সম্পন্ন করিয়া পকেট হইতে পাঁচশো টাকার কাগুজে মুদ্রা বাহির করিয়া বলিলেন ---
--- ভ্রাতা মূল্যটি গ্রহণ করুন ।
--- আমি কহিলাম এই সামান্য আহারের উদ্দেশ্যে আমি আপনার নিকট হইতে অর্থ গ্রহণ করিতে পারিবো না বরং এই অর্থ আপনি রাখিয়া দিন কারণ অদ্য আপনি আমার বাটিকার অতিথি হইয়া আরাধনার প্রসাদ গ্রহণ করিয়াছেন।
--- আহারটি আমার নিকট সামান্য নহে , এইটি আমার জীবনদায়ী। একজন অভুক্ত মানুষের নিকট এই জীবন দায়ী আহারের কোন তুলনাই হয় না , তাহার কোন মুল্যও হয় না । আর অর্থের কথা কহিতেছেন দেখুন আমি আপনাকে বৃহৎ অঙ্কের অর্থ প্রদান করিতে চাহিয়াও আহার পাই নাই , অথচ আপনিই আহার দিয়া মূল্য গ্রহণ করিতে চাহিতেছেন না । এই অর্থের কি মুল্য আছে বলুন , যে অর্থ অসময়ে কোন কর্মে আসে নাই , বিপদের দিবসে যে অর্থ বিপদ হইতে উদ্ধার করিতে পারেনাই , সেই অর্থ মুল্যহীন । আপনি আমার যে উপকার করিলেন তাহার নিমিত্ত ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করিবেন , এই বলিয়া ভদ্রলোক চলিয়া গেলেন ।
কুন্তলবাবু মোনালিসার মস্তিষ্কের উপর স্নেহশীলতাবশত হস্ত বুলাইয়া কহিলেন মা মোনালিসা , এই সেই কাগুজে মুদ্রা যাহা ভদ্রলোকটি বিদীর্ণ করিয়া ফেলিয়া দিয়াছিলেন । আর আমি সেই বিদীর্ণ কাগুজে মুদ্রার অংশ গুলিকে কুড়াইয়া , লেই সহযোগে জোড়া লাগাইয়া প্লাস্টিকের আধারের মধ্যে যত্ন করিয়া সম্পদ ভাবিয়া , বুকে আগলাইয়া তুলিয়া রাখিয়াছি ।এই সম্পদটিকে আমি বিনষ্ট হইতে দিতে পারিনা কারণ এটিই যে মুল্যহীন অর্থের ঈশ্বরিক স্মৃতি সম্পদ ।
পিতার মুখে মোনালিসা একথা শ্রবণ করিয়া পিতার মুখমন্ডল পানে অহরহ তাকাইয়া রহিল ।।
************** সমাপ্ত ************ তারিখ :: ২৯ । ০৯ ।১৯ রাজীব রং ---- ।
Tags
Literature