তিনসন্ধ্যার বেলা, নষ্করপাড়ায় সন্ধ্যাবাতি জ্বালানোর রোল পড়েছে। এদিক ওদিক থেকে ধূপ - ধূনা গন্ধের সাথে তালমিলিয়ে সমান্তরালে কাঁসর - শঙ্খধ্বনি কানে ভেসে আসছে। এমতাবস্থায় বলরাম নষ্কর ঘরের খাটের উপর ভ্রাতুষ্পুত্র সুজিতকে বসিয়ে, তার পৃথক সাংসারিক জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম খোঁজ- খবর নিচ্ছেন ।
তিন সহোদরের পৃথক সংসারে বলরাম কনিষ্ঠ , গোপাল ও কানাই যথাক্রমে বড় ও মেজ সহোদর।
মেজ'সহোদর কানাইয়ের দুই পুত্র যথাক্রমে অজিত নষ্কর ও সুজিত নষ্কর, অন্যদিকে গোপাল ও বলরামের উভয়ের দুটি করে কন্যা সন্তান। উল্লেখিত বংশতালিকা অনুসারে সুজিত হল বলরাম নষ্করের আপন কনিষ্ঠ ভ্রাতুষ্পুত্র ।
এই শুভসন্ধিক্ষনে বলরামের স্ত্রী কাঁকন, সুতির লাল গরদের শাড়ি আটপৌরে ঢঙে পরে কোন রকমে লজ্জা নিবারণের ব্যবস্থায় ধুচনির অন্দরে সন্ধ্যাবাতি বসিয়ে ঘরের অন্দরকার ঠাকুরের খটুলিতে সন্ধ্যাবাতি দেখানোর পর , ঘর থেকে প্রস্থানমুহূর্তে সুজিতের উদ্দেশ্যে বলল ,
--- বাবা সুজিত , তোর কাকু কি বলছে মন দিয়ে শুন বাবা । তুই ছাড়া কে'বা আমাদের কথা শুনবে আর কে'বা আমাদের মুখাগ্নি করবে বল !
এই তিনসন্ধ্যার বেলা সন্ধ্যাবাতি হাতে স্ত্রী কাঁকন নিজেদের মুখাগ্নির অলগ্ন - কুলগ্নের কথা নিজমুখে উচ্চারণ করায় , বলরাম মুহূর্তের মধ্যেই ক্রোধান্বিত হয়ে কটমটিয়ে চোয়ালচেপে তির্যক দৃষ্টিতে স্ত্রীর পানে তাকিয়ে বলল ,
--- তুমি কি মানুষ ! কখন কি কথা বলতে হয় সেটাও জান না ? সন্ধ্যাবাতি হাতে আছে সে খেয়াল তোমার আছে , নাকি তাও নেই। যা মনে আসবে , তাই বলবে - গন্ডমূর্খ কোথাকার। এখন এখান থেকে যাও , ছেলেটা অনেক দিনের পর আমাদের বাড়িতে এসেছে , সন্ধ্যা আরতির কাজ শেষ করে কিছু মুখে দেওয়ার ব্যবস্থা করো । এখানে দাঁড়িয়ে আর অযথা ভ্যান-ভ্যান করো না।
এই কথা শুনে সুজিত , ক্রোধে উত্তেজিত পিতৃব্য বলরামকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলল ,
---থাকনা কাকু আর কথা বাড়ানোর দরকার কি ! কাকিমা বুঝতে পারেনি তাই এই রকম একটি কথা বলে ফেলেছেন , ছাড়োতো।
সুজিত কাকু বলরামের অভিমুখ থেকে কাকিমার অভিমুখে মুখ ফিরিয়ে পুনরায় বলল --- কাকিমা, শোনো- শোনো , এখন নাস্তার ব্যবস্থা করার কোনো প্রয়োজন নেই , আমি কিছুক্ষন পূর্বেই নাস্তা সেরে এসেছি।
আবারও সুজিত পিতৃব্য বলরামের অভিমুখে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করে --- কাকু আমাকে ডেকেছিলে কি যেন বলবে ?
---- না না তেমন কিছু না। আসলে বাহিরে থাকিস তো তাই এখন কোথায় থাকিস ? কবে দেশে আসলি ? কেমন আছিস ? এই অতিমারি সময়েও কিভাবে দেশে ফিরে আসলি ? এই সব জিজ্ঞাসা করবো বলেই ডেকেছিলাম।
সুজিত বন্ধ শিলং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে, খাটের উপর পড়ে থাকা তালপাতার হাতপাখাটি তুলে একটির পর একটি রিদিমে পাখাটি টানতে আরম্ভ করে পিতৃব্য বলরামের প্রতিবাক্যে বলে ,
--- ও , আমি ভাবলাম পুনরায় কিছু হয়েছে নাকি ? সে যাইহোক কাকু, আমি এখন ইন্দোরে থাকি। ওখানে বেশ ভালই আছি। আর এই তো , গত সানডে' তে ফিরে এসেছি।
বলরাম নষ্কর, হাত নেড়ে শারীরিক ভাষায় দীর্ঘক্ষণ ইলেকট্রিক না থাকার কথা জানিয়ে , ভ্রাতুষ্পুত্র সুজিতের বক্তব্যের উপর অতিরিক্ত কৌতুহল প্রকাশ করে বলে ,
--- কেন সুজিত , তুই কি ভাবছিলি ?
--- আসলে আমি ভাবছিলাম , গোপাল জ্যেঠুর মুখাগ্নিকে কেন্দ্র করে তোমার সাথে দাদার, জমিজমা সংক্রান্ত যে বিবাদ হয়েছিল , হয়তো সে ব্যাপারে কিছু বলতেই আমাকে ডেকেছো।
বলরাম বেশ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে বলে --- এসব কথা তোকে কে বললো ?
সুজিত হাতপাখাটি আপন মনে টানলেও , ক্রমশ অধিক গরম বৃদ্ধি পাওয়ায় উর্দ্ধ থেকে নিম্নে পরপর দুটি শার্টের বোতাম উন্মুক্ত করে পুনরায় হাতপাখা আরও নৈকট্যে টানতে টানতে বলে ,
--- তখন দাদাই আমাকে ফোন করে বলেছিল , যে গোপাল জ্যেঠু গত হওয়ার পর বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ; দাদা জ্যেঠুর মুখাগ্নি করলে তাকে দু'কাঠা ধানজমি দেওয়া হবে , সেই বৈঠকে তুমিও উপস্থিত ছিলে। তারপর জ্যেঠুর পরলৌকিক্ ক্রিয়াকর্ম সমাপ্তের পর বিষয়টি জ্যেঠিমাকে জানালে , জ্যেঠিমা বলে - " আমি তোকে দু'কাঠা জমি দিতে পারবো না , বিপদের ঘরে মাথা ঠিক ছিল না , তাই যে যা বলেছে তাতেই সম্মতি জানিয়েছি। তোর বলরাম কাকুও তো সেদিন উপস্থিত ছিল , তাকেই জিজ্ঞাসা করনা সে কি বলে " । অতঃপর দাদা তোমাকে জিজ্ঞাসা করলে তুমি বলো , যে এককাঠা জমি দেওয়ায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, অন্যথায় দশহাজার টাকা। সুজিতের বক্তব্য সমাপ্তির পূর্বেই, বলরাম ইতস্ততঃ বোধকরে বাম হাতে পরনের লুঙ্গি চেপে ধরে , ডান হাতে তারই এককোন তুলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলতে আরম্ভ করে ,
--- দ্যাখ সুজিত, আমি জানি তোর দাদা মানে অজিতের জমি জায়গা কম , যা আছে তার সাথে দু'কাঠা ধানজমি যুক্ত হলে , হয়তো খেটেখুটে সারা'বৎসরের খোরাকির ধানটা হয়ে যাবে। তাছাড়া আমার পাঁচবিঘা জমি থাকতেই পারে , তাবলে আমি দু'কাঠা জমি দিয়ে দেবো ; এখন দু'কাঠা জমির দাম কতো ! এবার সুজিত তুই-ই বিবেচনা করে বলতো , আমি যে দশ হাজার টাকা দেবার কথা বলেছিলাম , ভুল বলেছিলাম ? সেই তো বাবা পনেরো দিন না'হয়, কাছা গলায় অশুচ পালন করে ক্ষৌরকর্ম করেছিস , তার অধিক তো আর কিছু নয় । আবার যদি বৌদি অর্থাৎ তোর বড় জ্যেঠিমা পরলোকগমন করে তাহলে তো পুনরায় দু'কাঠা চেয়ে বসবি !
সুজিত পিতৃব্য বলরামের কথায় প্রভাবিত হয়ে, দাদা অজিতকে পরোক্ষভাবে তিরস্কারের তীক্ষ্ণ শব্দশরে বিদ্ধ করে বলে ,
--- সে'তো অবশ্যই , সে আর বলতে ।
বলরাম সুজিতের কথার পরিপ্রেক্ষিতে আর এক কদম এগিয়ে , আগ্রহ সহকারে তাকেই জিজ্ঞাসা করে বলে,
--- তোর দাদা এখন এই ব্যাপারে, তোকে কি কোন কিছু বলেছে ?
--- না না । গত এক বছর হলো আমাদের সাথে তাদের কথা নেই । যা অল্প - সল্প কথাবার্তা হয় তাও আবার বাবা মায়ের সাথেই , দাদার সাথে নয়।
--- কেন ? কেন কথা বলিস না ?
--- ওই যে , আমার সাথেও জমি নিয়ে বিবাদ । তার বক্তব্য আমাদের যে চাষের জমি আছে , তাকে তিনভাগ করে দু'ভাগ সে চাষ করবে , আর আমার একভাগ । তখন আমি তাকে বললাম , কোন যুক্তিতে তুই একথা বলছিস দাদা। সে কি বললো জানো কাকু - সে বলছে তুইতো জমির ভাগ নিয়ে লিজে দিয়ে দিবি , তার উপর আমি বাবা - মাকে খাওয়াচ্ছি - পরাচ্ছি , পূজা - আর্চনা , আত্মীয় -পরিজন দেখছি তাই । এবার তুমিই বল কাকু , এটা কোন কথা হয় , শুধুমাত্র এই যুক্তিতে দাদা দু'ভাগ জমি চাইতে পারে !
বলরাম নিজে - নিজেই ক্রোধে চোয়ালে চোয়াল চেপে সুজিতকে উত্তেজিত করার পরামর্শ দিতে চেয়ে বলে ,
--- তখন তুই তাকে বললি না ! যে বাবা- মা তোর কাছে তো আর এমনি- এমনি খায়না , তারা এই বয়সেও মাঠে - ঘাটে গিয়ে যথেষ্ট কষ্ট করেই খায় । আর জমি লিজের কথা বলছিস , আমি আমার জমি লিজ দেই বা ভাগাড় করে ফেলে রাখি তাতে তোর কি ।
--- ঠিক বলেছো কাকু ।
--- আরে আমার সাথেও সেই একই কারণে বিবাদ । আমার বক্তব্য হল গোপালদার পাঁচ বিঘা জমি আছে ঠিক কথা । কিন্তু তার স্ত্রী তো এখনো বেঁচে আছে , সে রেখে মরবে না খেয়ে মরবে তার কোন যথার্থ উত্তর নেই । তারপরেও তার অবর্তমানে যদি অবশিষ্টাংশ কিছু টিকে থাকে তাদের মেয়ে জামাইরা ভোগ করবে । অজিতকে শুধু শুধু দু'কাঠা জমি দিতে যাবে কোন দুঃখে ।
--- ঠিকই তো কথা , তার মেয়ে জামাইরা আছে ।
বলরাম ভ্রাতুষ্পুত্র সুজিতের বক্তব্যে অজিত সম্পর্কে প্রতিহিংসার পারদ কতটা উর্দ্ধমুখি তা নিশ্চিতভাবে পরিমাপ করতে চেয়ে বলে ,
--- এখন নাকি লোকের কাছে ব্যক্ত করছে , " নিজেদের ঘরের লোক হয়েও আমাকে একেবারে অস্বীকার করে দিল। কাকু যদি আমাকে বুঝিয়ে বলতো , যে দ্যাখ অজিত দু'কাঠা জমিই দেবো কিন্তু তোর জ্যেঠিমা প্রাণগতা হলে তার শ্রাদ্ধ-শান্তির কাজটাও তোকেই করে দিতে হবে অথবা এও যদি বলত , এখন এককাঠা জমি নে আর তোর জ্যেঠিমার বেলায় এককাঠা জমি নিবি, তাহলে কি আমি অস্বীকার করতাম , নাকি কাজটা বহিয়ে দিতাম। তাঁর জায়গায় আমাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে দিল "।
একথা শুনে সুজিত নিজের দাদার উদ্দেশ্যে সীমা - পরিসীমা হীন , লোভী তকমা লাগিয়ে বাস্তব জীবনে উপযুক্ত শিক্ষার প্রসঙ্গ তুলে বলে ,
--- অহেতুক আবদার করলে তো তোকে অস্বীকার করবেই । মানুষের লোভের সীমা আছে , সেই সীমা লঙ্ঘন হলেই তা অনিশ্চিয়তার সীমানায় প্রবেশ করে । সবচেয়ে বড়কথা তোমরা তো দশ হাজার টাকা দিবে বলেছিলে , খারাপ কিছু তো বলোনি । এখন কি হলো , জমিও গেল দশ হাজার টাকাও পেলি না । এবার পড়ল'তো জোঁকের মুখে নুন ।
সঙ্গে সঙ্গে বলরাম বড় - বড় চোখ করে নিজেই নিজের মুখে আঙ্গুল চেপে বলে
--- না না সুজিত , একথা ভুল করেও বলিস না । তোর দাদা আমাকে রীতিমত আঙ্গুল উঁচিয়ে শাসিয়ে বলে গেছে , "এর হিসাব তুলা থাকলো বলরাম কাকু , সময় এলে ঠিক কড়ায়-গন্ডায় হিসাব বুঝে দেবো"।
এই বলে বলরাম, নিজের ও সুজিতের উদ্দেশ্যে স্ত্রী কাঁকনের বাড়ানো নাস্তার প্লেট খাটের উপর রেখে পুনরায় বলে ,
--- নে সুজিত , খেয়ে নে । মুখে কিছু দিতে দিতে কথা বল । আর কি বলতো ! আমার মনে হয় ভবিষ্যতের কথা , এখন থেকে ভেবে কোন লাভ নেই ।
সুজিত পিতৃব্যের বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে বলে --- কি বলছো কাকু আমরা একবিংশ শতাব্দীর কুসংস্কারমুক্ত আধুনিক যুগের মানুষ । আমরা ভবিষ্যতের কথা ভাববো না, তা কি করে হয় । আর আমিই বা কতদিন আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীদের পিছুটানে ইন্দোর থেকে দেশে যাতায়াত-ই বা করবো বলো। তাই আমিতো ঘর- বাড়ি বানিয়ে ওখানেই বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে শহরের বুকে কাঠা'দুই জায়গা কিনেছি। রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড ওখানকার ঠিকানায় বানিয়ে নিয়েছি। কি জানতো দেশের ঘরে এত সমস্যা আমাকে ভালো লাগে না । এই যে ধরো সামান্য গোপাল জ্যেঠুর মুখাগ্নিকে কেন্দ্র করে দাদার সাথে তোমাদের যে ফালতু বিবাদ হয়েছে , ওটা আমার সাথেও হতে পারতো। তাহলে আমিও শুধুমাত্র লোভের বশীভূত হয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়তাম , আমার এত জমির লোভও নেই , তাই আমার কারো সাথে বিবাদ বাঁধাতেও নেই। আমি এখন ইন্দোর শহরে যা ব্যাবসা চালু করেছি , তাতে আমার ছেলের ছেলে করে খাবে।
সুজিতের মুখে অশনিসঙ্কেতের কথা শুনে, বলরাম নষ্কর নিজের মুখাগ্নি সংক্রান্ত আশার , যে বালির বাঁধ নির্মাণ করতে চেয়েছিল , তা শহুরে প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক প্লাবনে মুহূর্তের মধ্যেই ভেঙে গেল। আর সেই বাঁধ ভাঙার শব্দ , অজিতের শাসানো শব্দ হয়ে পুনঃপুনঃ বলরামের কানে বিঁধতে লাগলো। বলরাম মনে মনে বলেতে থাকে - আজ আমার অন্তরে যে আগুন হু-হু করে জ্বলে উঠছে , অজিতের শাসানোর দিনই সেই আগুন মুখাগ্নি রুপে অন্তরে প্রবেশ করেছিল। তাই আজ আমার খুব মনে হচ্ছে পুত্র সন্তানের হাতে মুখাগ্নিই যদি সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনের পরম পাওয়া হয় , তাহলে আমার মত অপুত্রক দম্পতিদের মুখাগ্নির বিবাদ এড়িয়ে চলাই মঙ্গলজনক।
________________সমাপ্ত__________________
রবিবাসরীয় ছোটগল্প --" মুখাগ্নি "
কালি কলম-- রাজীব রং
দিবারাত্রি --- ২৭/ ০৬/২১