স্মরণের এই বালুকাবেলায় চরণচিহ্ন আঁকি



“ স্মরণের এই
বালুকাবেলায়
চরণচিহ্ন আঁকি , ...”
( অর্ধশতক পূর্বের এক বিদ্যালয়
প্রাক্তনের মধুর স্মৃতিচারণা ,
( ১৯৪৪ - ৪৯ ) ।
শ্রীকালীপদ চৌধুরী
প্রাক্তন ছাত্র ,
১৯৪৪ – ৪৯
( বিশ্বভারতী , শান্তিনিকেতন ) ।
৩-১০-৯৫


[সূত্র : – আবারো অনুজের চিঠি — একেবারে স্বয়ং স্মারক গ্রন্থ উপসমিতির আহবায়ক সম্পাদক এমন সুভাষ চৌধুরীর চিঠি। কী ব্যাপার ? লেখা চাই । জীবনের প্রথম শিক্ষ । মাতৃভূমি মনসুকা বিদ্যালয় তার ৫০ বর্ষ পূর্তি উৎসবে স্মারকগ্রন্থ বের করছে । অতএব• • • । বুঝলাম । কিন্তু •• । পূজার আগেই ? এদিকে কাজে হিমসিম , অচিরেই দূর ভ্রমণে পাড়ি দেওয়ার কথা । এদিকে অবসরের ঘণ্টা বেজে গেছে । অসম্ভব চাপ চলছে । তবু এ যে মনসুকা বিদ্যালয় — চিরদিনের মনোমাতৃভূমি , শিক্ষাজীবনের আদি গঙ্গা । আবার অনেক কাজের অভিভবিকাওৎ তাই•••••• । অতএব....। ও বিদ্যালয়েই এক উৎসবের উদ্দেশ্যে রচিত হয় । লেখাটি ২৭ ৫ - ৯৪ তে তারই সংযােজন - বিয়োজন জনিত কারণে বর্তমান রূপটি রয়িতা ]

কথামুখ ।
“ স্মরণের এই বালুকাবেলায়
চরণচিহ্ন আঁকি ' ,
তুমি চলে গেছ দূর , বহু দূরে –
শুধু পরিচয়টুকু রাখি । ”


সুদুর কৈশোরের স্মৃতিপটে যে চরণ চিহ্নগুলি হয়েছিল আঁকা দিন হতে দিনে , তারে আজ বার্ধক্যের বালুকা বেলার তীরে বসে ফেরাই কেমনে ! যে পদচিহ্নে একদিন সাক্ষাৎ প্রণতি জানিয়েছি বারে বারে বিদ্যামন্দিরে প্রথম প্রবেশক্ষণে , পরীক্ষার পূর্বল , পরীক্ষাফল প্রকাশক্ষণে , কিংবা বিদ্যাদায়িনীর পূজাপ্রাঙ্গণে , নববর্ষের প্রথম প্রভাতে , পূজাবকাশের পরে প্রথম যােগদান দিনে , অবার হয়ত বা স্মৃতি বার্ষিকীর সভায় পুরস্কার গ্রহণের পরে , কিংবা এসবেরও বাইরে পথে - প্রান্তরে , হাটে - মাঠে ঘাটে - বাটে , বাজারে - দোকানে , গৃহে গৃহান্তরে , পূজার মণ্ডপে , উৎসবের আঙিনায় , যাত্রার আসরে বা নাটকের রঙ্গশালায় – যখনই যেথায় পেয়েছি দেখা সেইসব গুরুমহাশয়দের , তখনই সেথায় সাগ্রহে তাদের প্রাণের প্রণতি জানিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেছি সেদিন । কিন্তু আজ -- যে কাহিনী চল্লিশের দশকে শুরু হয়ে আজ নববই এর দশক শেষের আঙিনায় অপেক্ষারত , ছ ' টি দশক শেষে বিস্মৃতির প্রলেপ সে কাহিনীতে তাে পড়বেই আষ্টে-পৃষ্ঠে । তাই , সে প্রলেপের গাঢ় আস্তরণকে সরিয়ে কতখানিই বা সেই চরণচিহ্নকে খুঁজে পাব , আজ আর তা বুক ঠুকে বলতে পারছি না । ভরসা এই যে , চরণচিহ্ন মিলিয়ে গেছে চরণেরই সাথে , তার দেহীর সাথে , কিন্তু তার পরিচয়টুকু ? সে তো রয়ে গেছে আজও যারা বেঁচে আছে , তাদেরই মনে , অতি সঙ্গোপণে । হ্যাঁ , সেই সে পরিচয়ের সূত্রই । আমার আজের এই স্মৃতিচারণার একমাত্র পথ চলার পাথেয়কণা । জানিনে , এ মধুর স্মৃতিচারণার অঙ্গণে যাদের স্মরণে এনে মননপূজার বেদী ’ পরে বসাচ্ছি , তাদের মধ্যে আজও ক ' জনই বা বেঁচে - বর্তে আছেন ইহলােকে , অন্ততঃ বিদ্যা মন্দির - প্রাঙ্গণে তাদের আর এক জনেরও যে পদরেণু মিশে নেই , সেটুকু হয়ত বাস্তব সত্য , একমাত্র একজন ছাড়া - - যাকে আমরা মাত্রই কয়েকবছর আগে বিদায় অভিনন্দনে ভূষিত করে নিজেদের কৃতার্থ মনে করেছি । আমি শ্রদ্ধেয় প্রাক্তন শিক্ষাগুরু শ্ৰীযুত , বুদ্ধিমন্ত বের মহােদয়ের কথা বলছি । কথামূখ হ'ল শেষ , সুরু হােক স্মৃতিচারণা...

১ . স্মৃতিচারণ :

সে ছিল চল্লিশের দশক , পরাধীনতার নাগপাশ সেদিন জাতির শরীরে ছিল আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে , ইং ১৯৪৪ সাল। ‘ ঝুমি ’ নদীর এপারে মেঠেলা দীর্ঘ গ্রাম আমার মাতৃভূমি , আর ওপারে মনসুকা আমার প্রথম শিক্ষা মাতৃভূমি । দুই ভূমিই তাই আমার চিরপ্রণমা , প্রাতঃমণীয়া , আমার ইষ্টদেবীসমা ।
ঐ সালেরই জানুয়ারীর এক শুভদিনে বড়কাকাবাবু ( ঐ অঞ্চলের সুপরিচিত জন প্রয়াত বিশ্বনাথ চৌধুরী মহাশয় ) - এর সাথে চলেছি বিদ্যামন্দিরে ভর্তি হওয়ার আশায় । কিন্তু ঐ পুণ্যভূমিতে যাওয়ার আগেই এ পারের মানুষদের তখন ‘ ঝুমি নিজেই একটা ক'রে পরীক্ষা নিত । সে পরীক্ষা প্রায়ই চলত , অনেকেই তাতে অকৃতকার্যও হত । আমিও বাদ গেলাম না । পারাপারের জন্য তখন নদীর ঘাটে থাকত ১ জোড়া তালগাছের ডােঙ্গা । নৌকা বা ডিঙ্গি ’ এসেছে অনেক পরে নদী ছিল গভীর , জল থাকত বেশ । সে সময়টায় আবার নদীতে বাঁধ থাকত ‘ বােরো চাষের জন্য । ‘ নীল যমুনার জল ” যেন ফুসত সব সময় । ভারী চমৎকার লাগত শীতের নিসর্গ প্রকৃতিটাকে ! চারিদিকে রবিশস্য আখের গুড়ের গন্ধে চারিদিক যেন ম-ম করতো! ঠিক এমন দিনে এমন ক্ষণে চলেওছি ঘাটাল মহকুমার শস্যভাণ্ডার সেই মনসুকাতেই। তার আগে আর কখনাে যাইনি । তোই প্রথম দর্শনেই জায়গাটাকে ভাল লেগে গেল ! আরও ভাল লাগল যখন ২য় শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে গেলাম । তাই একই সঙ্গে মনসুকা ও তার বিদ্যামন্দিরকে ভালবেসেই ফেললাম । শুরু হল নূতনযাত্রা । এক অজানা দিগন্তের দ্বার যেন খুলে গেল সেদিনের কিশোরের চোখের সামনে । আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাড়ী ফিরছি । আবার ঝুমি , আবার ডােঙ্গা । আসার সময় ঝুলি ছিল নীরব দর্শক হয়ে । ফেরার সময় সে কি আর ছাড়ে ? পরীক্ষা দাও , তবে বাড়ী যাও । এপারে ভােঙ্গা লাগতেই কাকাবাবু বললেন , “ নে , নামদিকিনি দেখি । মরলাম এক লাফ । সঙ্গে কে যেন খিল খিলিয়ে হেসে উঠল ? ইস , ঝুমি ! কেন , কী হ’ল ব্যাপারটা ? ও , তাই বলো ? আমি যে তখন পপাত ঝুমিতলে । পােষাক - খাতা সবই গেল ভিজে । কাকাবাবু বললেন , “ হু : ! তাের কিছু হবেনি । " হলেনি তাে হবেনি , কী আর করব ? কিন্তু সেই সুরু । ঝুমির পরীক্ষায় আরো কয়েকবার অকৃতকার্য হয়েছি বটে , কিন্তু বিদ্যালয় আমায় ঠকায়নি , তাই আর ফিরে তাকাতে হয়নি কোনদিন । দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছরেরও উপর এই মাতৃসমা পুণ্যভূমির স্পর্শ পেয়ে নিজেকে তিল তিল করে গড়েছি , ধন্য হয়েছি । পিতৃসম গুরুমহাশয়দের স্নেহের দাক্ষিণ্যে , তাঁদের চরণতলে বসে , দিন হ’তে দিনে , মাস হতে মাসে , বছর হ'তে বছরে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছি । খুবই গরীব ছিলাম , পরের বাড়ীতে পরের বই পড়ে পড়া তৈরী করতাম । অর্ধেক দিন ঠিক মত আহারই জুটতনা , পোষাক তাে নয়ই । কিন্তু এ ছিল আমার অবস্থার দারিদ্র্য , শিক্ষাকে সে কাবু করতে পারেনি , পারেনি রােগ শোকও , হ্যাঁ , নিঠুর দরদী ' বিধির হয়ত এদিকটায় আমার প্রতি কিছুটা বেশীই দরদ ছিল । তাই হয়ত চলাপথের এই সব নুড়ি - পাথরকে , বাধাকে অমিত বিক্রমে পার হয়ে এসেছি সেদিন , সবদিন এবং আজও । বিদ্যালয়ে এ খেলাধূলা ছিল , আনন্দ গান ছিল , ছিল পরীক্ষা - প্রস্তুতির তীব্র প্রতিযোগিতার মহড়া । সে এক অনাস্বাদিতপূর্ব পুলক শিহরণ ! তারপর ফল ঘােষনার প্রাক্ মুহূর্তের সেই মানসিক রােমাঞ্চ ও টান টান উত্তেজনা ! উঃ ! ভাবা যায় ! শিক্ষাগুরুগণ একে একে উচু শ্রেণীতে ওঠার নাম ডেকে চলেছেন , আর আমরা ছাত্রছাত্রীরা ঠক ঠক করে ‘ গড় ’ ( প্রণাম ) করে চলেছি তাঁদের চরণতলে । অঙ্কে কাঁচা ছিলেম , বিজ্ঞানও তেমন করে আমায় টানত না । তবু প্রতি বছর ১ম বা ২য় স্থান ছাড়া ৩য় স্থানে কখনাে গেছি বলে মনেই পরেনা।

১ম স্তরীয় শিক্ষার শিক্ষাগুরুবৃন্দ :-

আমাদের নীচু শ্রেণীর ইংরেজী শিক্ষক ছিলেন প্রয়াত রামপদ পেড়ে মহাশয় । তার হাতেই আমার ইংরাজী শিক্ষার হাতে খড়ি , তিনিই শেখান ইংরাজী আবৃত্তি । অর্ধশতকেরও আগে একটি ২য় শ্রেণীর নিতান্ত নাবালক ছাত্রকে আবৃত্তি শিখিয়ে , সাহস জুগিয়ে স্মৃতিবার্ষিকীর মত বিরাট জনসভায় পাঠও করিয়েছিলেন । তাও ইংরাজীতে । সে আবৃত্তি শুনে আমার বড় কাকাবাবুও মুগ্ধ হ'য়ে প্রশংসা করেন বলে শুনেছি । পরের বছর বা তারও পরে কিনা মনে নেই , ইংরাজী আবৃত্তি করে আরও চমক দেওয়া গেল “ Psalm of Life ” - এর মত দীর্ঘ ও কঠিন কবিতাটি আবৃত্তি করে । এবারে অবশ্য রূপকার ছিলেন শিক্ষাগুরু মহেন্দ্র পাড়িই ( ? ) মহাশয় । চারদিকে জয় জয় কার পড়ে গেল । বড় কাকাবাবু এবার আমায় আশীর্বাদ করলেন । তিনিই প্রথম দিনে বলেছিলেন “ হু ; ! তাের কিছু হবেনি । ” এদিন থেকেই বােধহয় তিনি আমার প্রতি ধারণাটাই জীবনের মত বদলে নেন । অঙ্ক ও ভূগােলে ছিলেন প্রয়াত রাখাল চন্দ্র পাখিরা ( ? ) মহাশয় । চেহারায় , পােষাকে , শিক্ষাদানে , দরাজগলায় ও শাসনে প্রকৃতই এক নিখাদ গুরু বা মাষ্টার মশাই ছিলেন । দেখলেই সম্ভ্রম জাগত , খুব কড়া শাসনে রাখতেন , পড়াও ঠিক ঠিক আদায় করা চাই - ই চাই । এক সম্রম জাগানাে ভয়ে তার নজরে পড়তে চাইতাম না । সম্ভবতঃ খদ্দরের ধুতি আর হাফসার্টই তাঁর পরিধেয় ছিল । পায়ে থাকত সেকালের স্যাণ্ডাল বা চটি । কিশাের মনে ভক্তি যেন আপনা থেকেই জাগত । প্রায় সকল শিক্ষাগুরুরই এই একই রকমের পােষাক ছিল । শ্রেণী বদলের সঙ্গে শিক্ষকেরও ঘটত বদল । এবার ভূগােল ও মানচিত্র - অঙ্কন , ইতিহাস ও খেলাধুলায় এলেন প্রয়াত কানাইলাল দোলই মহাশয় । ইনি ছিলেন । তৎকালীন জি - টি শিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক । মানচিত্র আঁকা ও তাতে রঙ ফলানাের কায়দার হাতে খড়ি এঁর কাছেই হয় । এই শিক্ষাই একদিন উচ শ্রেণীতেও ১৪ - এর মধ্যে ১২ নাম্বার পেতে সাহায্য করে আমার দ্বিতীয় বিদ্যালয় জীবনে — ক্ষীরপাই বিদ্যালয়ে। এই মনসুকা বিদ্যালয়েই আমার অনেক বিদ্যার দ্বার খুলে যায় , বুনেদ পাকা হয়ে যায় । নিজের ভেতর চুম্বক হয়ত ছিলই , কি সেরকম ইস্পাত মিশ্রিত লোহার স্পর্শও তাে পাওয়া চাই , নইলে নিতান্ত খাদ - মেশানাে কাঁচা লােহায় কি ঠিক আকর্ষণ ঘটে ? কী জানি ? আমি আবার বিজ্ঞানের ছাত্র নই যে , এ তত্ত্ব জেনে থাকব । আরাে দু ’ টি মহৎ গুণের অধিকারী ছিলেন ইনি । একদিকে গল্পের যাদুকর , আবার অন্যদিকে যাত্রা ও নাটকের পাকা অভিনেতা । ভয়ানক রাশভারী এক রাজা সাজতেন বা তেজস্বী সেনাপতির ভূমিকায় । চেহারাও যেমন ছিল , গলার জোরও তেমনি ছিল । স্বভাবেও একদিকে যেমন বজ্রাদপি কঠোরণি ছিলেন , চাবুক চালাতেন বজেরই মতন , আবার মৃদুনি কুসুমাদপি হ'য়ে আমাদের সঙ্গে একাত্ম বন্ধু হয়ে যেতেন । সেদিনের শিক্ষাগুরুদের কমবেশী সকলেই ঠিক এই ভূমিকাটিই নিতেন – যা শিক্ষাক্ষেত্রে একান্ত বাঞ্ছনীয় । শিক্ষাগুরুদের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা - ভক্তি যেমন থাকবে , তেমনি রােমহর্ষক শাসন , অত্যাচার , ইত্যাদি না করেও কিছুটা ভয়ের ছোঁয়া শিশু - কিশাের - মনে জাগিয়ে রাখা বােধ হয় ভালো । তাতে বুদ্ধিমান ছাত্র ছাত্রীর কথা ছেড়ে দিলেও সাধারণ মানের ছাত্র - ছাত্রীদের জীবনে উপকার দেয় বেশী , কারণ ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা নিয়ে তাদের জীবনের বুনেদটাই গড়া হয়ে যায় । আজকের মত স্বেচ্ছাচার , অনাচারগড়ে ওঠার অবকাশই থাকে না । আজ কিন্তু ব্যাপারটার একেবারেই উল্টে গেছে হাল , তাই পুরা শিক্ষা ব্যবস্থাটাই হচ্ছে যারপর নাই নাকাল । চেষ্টা হচ্ছে , প্রকল্প গড়া হচ্ছে ভূর ভূরি , কিন্তু সবই যাচ্ছে বিফলে । শিক্ষকই যদি তৈরি না হয় , শিক্ষার্থী তৈরী হতেই পারেনা । দুঃখিত , আমি বােধ হয় প্রসঙ্গান্তরে চলে চ্ছিলাম । এই বিশেষায়নের যুগে একজন অ-শিক্ষক সমাজের লােকের এসব মন্তব্য করা ঠিক না ।

হ্যা , যে কথা বলছিলাম । বিজ্ঞান , চিত্রাঙ্কন , খেলাধূলায় ছিলেন প্রয়াত সাধনকুমার জানা মহাশয় । প্রতিবন্ধী হয়েও তার সবকাজে , আদম উৎসাহদর্শনে আমরা শুধু হাঁ করে ভাবতাম ! ইনি একই সাথে ছিলেন নট , নাট্যকার , রূপকার , ও নাট্য - শিক্ষক । বােধ হয় রক্তেই তার নাট্য উপাদান মিশেছিল । তখনকার দিনের মনসুকায় নট - নাটক - নাট্যায়ন - এর পুরা ব্যাপারটাই যেন তিনিই প্রথম আমদানী করেন । পরে এবিষয়ে সহকারী হয়ে যােগ দেন আর এক নাট্যব্যক্তিত্ব — তিনি প্রয়াত মদনমােহন বেরা মহাশয় আরো পরে যােগ দেন পূর্বোক্ত শিক্ষাগুরু প্রয়াত কানাইলাল দোলই মহাশয় । এই শেষােক্ত দ্বয়ের তেজোদৃপ্ত অভিনয় সত্যিই মনে রাখার মত । আমাদের এপারেও যেমন বরকতিপুরের গাঁ । শীতলার মন্দির - প্রাঙ্গণে রায় - সেনবাড়ীর যৌথ উদ্যোগে প্রায়ই চলত নাট্য - রূপায়ণ । প্রয়াত বিশ্বনাথ রায় মহাশয় ছিলেন এখানের নটগুরু । চেহারাও যেমন ছিল , অভিনয় - ক্ষমতাও তদ্রুপ । তাঁর ছেলেরাও এখন মন্দ করেন না যাত্রাভিনয় । সেন বাড়ীর লােকেরাও বেশ ভাল অভিনয় করতেন । অজিত সেন বলে ১জন ছিলেন । সদাহাস্যময় । স্ত্রী ভূমিকা নিতেন । বড় ভাল লাগত । “ দিনগুলি মাের সােনার খাঁচায় রইল না — সেই - যে আমার , নানা রঙের দিনগুলি । ” আরাে উঁচু শ্ৰেণীত ইংরাজী ব্যাকরণ ও সংস্কৃত পড়াতেন প্রয়াত তপস্বীচরণ পোড়ে মহাশয় । গঠনে , আচরণে আর কর্তব্য পালনে সত্যিই তিনি তপস্বীর ভূমিকা নিয়ে গেছেন । নিজের কাজে যেমনি নিয়ম নিষ্ঠ তেমনি সময়ানুবর্তী । ছাত্রের কাছ থেকে পড়া আদায় কেমন করে করতে হয় , তা তিনি জানতেন । গ্রামারের খুটিনাটি তিনি নিপুণভাবেই শেখাতেন । ইংরাজীর ৩ জন প্রথিতযশা শিক্ষক ছিলেন । নীচু ও মধ্যম স্তরে ছিলেন ইনি — গ্রামারে , আর একটু উচুর দিকে ছিলেন মাষ্টার কাকাবাবু গ্রামার ও অনুবাদ শিক্ষায় | আর সবার উচুতে ছিলেন প্রয়াত পার্বতীচরণ মণ্ডল মহাশয় সাহিত্যে , গ্রামারে ও টানা মানে শেখাতে । যারাই এই এয়ীর কাছে এ ভাষা শিক্ষা পেয়েছেন , তাদেরই জীবন আলোকিত হয়ে গেছে বলেই আমার বিশ্বাস ।
ছাত্র - ছাত্রীদের মৃদু শাসনও করতেন । মাথায় গাট্ট । মরতেন ও জুলাপী টেনে দিতেন । একই । সঙ্গে অঙ্কে ও অবস্থায় দরিদ্র ছিলেন বলে তিনি দয়াপরবশ হয়ে বিনা পারিশ্রমিকে আমায় গৃহ শিক্ষকতাও করেছেন কিছুকাল , ঠিক যেমন করেন দীর্ঘকাল ধরে আমার কাকাবাবু সুবল চন্দ্র চৌধুরী মহাশয়ও । এই দুই মহাপ্রাণের কাছ আমার ঋণ অপরিশােধ্যই রয়ে গেছে এজন্মর মত । স্বল্পদিনের জন্য হলেও আরও একজনের । কাছে ঋণী আছি । তিনি ছিলেন অনেক উচু শ্রেণীর ( নবম ) অঙ্ক ও বিজ্ঞানের নূতন শিক্ষক “ কুণ্ডুবাবু ” পুরা নামটি মনে নেই । ক্ষীরপাই বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণীতে পড়াকালীন আমি আরও ১বার মনসুকা বিদ্যালয়ে ফিরে এসে ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হই । সে সময় এই তরুণ , স্নিগ্ধ ও উচ্চ শিক্ষিত মানুষটির সুমধুর ব্যবহারে মুগ্ধ হই । এর নূতন আদর্শে আমরা মুগ্ধ হই । ইনি সব কিছু গ্রাম্যতা , নীচতা থেকে মুক্ত হবার শিক্ষা দিতেন । কিছুদিন কাটিয়ে আমি ফিরে যাই আবার ক্ষীরপাই বিদ্যালয়ে , এই নূতন গুরুমহাশয়ও বেশী দিন থাকেন নি । এখানে বলে রাখা ভাল যে , মনসুকা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমার সামূহিক পাঠ্য জীবন বিনা বেতনে চালাবার ঢালাও অনুমতি দিয়ে আমায় ধন্য করে ছিলেন । আমি চিরকৃতজ্ঞ তাঁদের কাছে । ক্ষীরপাই বিদ্যালয়ও অর্দ্ধ বেতনে পড়ার অনুমতি দিয়ে আমায় চিরঋণী করেছে । আমার পরবর্তী যা কিছু শিক্ষা , তা সবাই চাকরী করতে করতে হয়েছে , আজও যার শেষ নেই , কিন্তু বিদ্যালয়ী পাঠ্যজীবন চালাতে যদি প্রাগুক্ত বিদ্যালয় দু ’ টি এগিয়ে না আসত , তবে জীবন হয়ত অন্য খাতেই বইত আমার । বলতে ভুলেছি , মনসুকায় প্রথম ভর্তির দিনে যে শিক্ষক মহাশয়ের সাথে পরিচয় হয় , তিনি প্রধান শিক্ষক শ্ৰীপ্রধান । বেশ সৌম্য ও নিরীহ মানুষটি ছিলেন । তখন বিদ্যালয়টি ছিল মধ্য ইংরাজী ( এম - ই ) বিদ্যালয় , অর্থাৎ ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত । দীর্ঘদিন পরে আমরা যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে উঠলাম , তখনই গুটিকয় ছাত্র নিয়ে ৭ম শ্রেণী খােলা হ’ল । এই শ্রেণীতে বেশীর ভাগ পাঠ নিতেন চন্দ্র ও সূর্য , অর্থাৎ মাষ্টার কাকাবাবু ও পার্বতীবাবু । এঁদের ১ম জনের হাতে ছিল অঙ্ক ও বাংলা , ২য় জনের হাতে ইংরেজীর পুরো সাম্রাজ্যটি । প্রধান ৩টি বিষয় নিশ্চিন্ত হ’ল । বাকীগুলির জন্যও কিছু
নূতন নিযুক্তি হতে থাকল । শিক্ষাগুরুগণ যেন একটি মালার মত এ বিদ্যালয়ের বুকে জড়ানো ছিল সেই সে প্রথম যুগে । আর এই মালার সুবাসে দূরদূরান্ত থেকে মধুমক্ষিকারূপী ছাত্র ছাত্রীর দল ছুটে আসত । প্রথম স্তর শেষ হ’ল ।

২য় স্তৱীয় শিক্ষার শিক্ষাগুরুবৃন্দ : ---

এই স্তরে এসে পেলাম আমার মাষ্টার কাকাবাবু ’ তথা বর্তমান স্মারকগ্রন্থ - এর আহ্বায়ক সম্পাদক সুভাষ চৌধুরীর প্রথিতযশা , পিতৃদেব প্রয়াত সুবলচন্দ্র চৌধুরী , সংস্কৃতের পণ্ডিত মহাশয় ( নাম মনে নেই ) এবং সদ্য অবসর প্রাপ্ত ও আমার শেষ শিক্ষাগুরু শ্ৰযুত বুদ্ধিমন্ত বেরা মহােদয়দের । এখানেই পাই প্রয়াত জহরলাল বক্সী মহাশয়কে , যিনি ছিলেন বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী । ভারত স্বাধীন করল যারা প্রভৃতির পুস্তক প্রণেতা ছিলেন । এসব বই দ্রুত পাঠ্য হিসাবে পড়তে হত । পড়াতেন ইংরাজী । কী যেন গণ্ডগােলে চলে গেলেন । এলেন অচ্যুতবাবু ( চক্রবর্তী ) ( ? ) । দাঁত ছিল এঁর অল্প , তাই পড়ানাে খুব একটা স্পষ্ট হত না । গোফ ছিল দারুণ । ছিলেন অনেককাল । এলেন কটারঙ ধারী এক শিক্ষক মশায় । বিদ্যালয়ের পাশে সপরিবারে থাকতেন । ইংরাজী পড়াতেন আর খুব বেত চালাতেন । অপরিচ্ছন্ন পোষাকেই বেশী থাকতেন । আমাদের অস্বস্তি লাগত খুবই । নামটি তাঁর অজানাই রয়ে গেছে আমার । এলেন মহেন্দ্রবাবু(পাড়ুই , না , পােড়া ? ) প্রমুখ । মহেন্দ্রবাবু ছিলেন বিজ্ঞানের শিক্ষক । পরীক্ষাগার । ( ল্যাবরেটরী ) তাে ছিল না , তাই চেয়ারে বসে । সেই নানা রকম হাত ঘুরিয়েই বিজ্ঞানের জটিল কুটিল পরীক্ষাগুলি বােঝাতেন । একে বিজ্ঞান ও অঙ্ক নাম শুনলেই আমার মাথায় অন্ততঃ পরপর ১০টা বজ্রাঘাত তাে পড়েই । তাই এই পারিয়ডটা আমার অসহ্যই জাগত । উপায় খুঁজতে লাগলাম। এই বিজ্ঞান ও অঙ্ককে ঠেকিয়ে বেশী নাম্বার তােলার জন্য একটি ঐচ্ছিক বিষয় - এর সন্ধানে রত হলাম । পেয়েও গেলাম পৌর বিজ্ঞান । ঠিক মনে নেই , মনসুকায় , না , ক্ষীরপাই - এ নবম শ্রেণীতে এই নূতন বিষয়ের উপর পড়াশুনা শুরু করলাম পূর্ণোদ্যমে । তবে এই স্তরের শেষােক্ত জনেরা তেমন করে কিশাের মনে দাগ কাটেননি । প্রাগুক্ত বাক জনদের কথা বলে শেষ করা যায় না , যাবে না । আর সে পরিসরও এখানে নেই । আজ জীবনের শেষ প্রহরে দাড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যে আমার সকৃতজ্ঞচিত্তের প্রণাম জানাই বারবার ।

৩য় বা শেষ স্তরীয় শিক্ষাগুরুদ্বয় :-

এটিও ২য় স্তরেরই অঙ্গ , কারণ যাদের কথা বলতে যাচ্ছি , তাদের আমরা আগেই পেয়েছি , বলেওছি কিছু কিছু । শুধু দু ' জনের সম্বন্ধে বিশেষ ভাবে বলার জন্যই এই অংশটিকে একটু আলাদা । স্থান করে দিয়েছি এবং ‘ বৃন্দ ’ - এর জায়গায় ‘ দ্বয় ’ ও বসিয়েছি । এটি বাস্তবের চিরকালীন প্রয়ােজন , কারণ , “ ঈশ্বরচন্দ্র - সুবলচন্দ্র - পার্বতীচরণ ” — এই যে ৩টি স্তম্ভ , এর উপরেই যেমন সেদিনের মনসুকা । বিদ্যালয় গঠিত হয়েছে , আজও একইভাবে দাড়িয়ে আছে । এ তিনের মননেই এসেছিল আগে এই বিদ্যালয় । তারপরে তার বাস্তব রূপ পেয়েছে । উৎসর্গীকৃত এ তিনের হোমোনলেই আহুতি হ'য়ে দাড়িয়ে আছে আজের মনসুকা বিদ্যালয় । এত ভালবাসা , এত বাৎসল্য ১টি প্রতিষ্ঠানের প্রতি ! হ্যা , তাই । এ ভাবা যায় না। আজের এই স্বাধীনোত্তর দেশের তথা মনসুকার মাটিতে দাড়িয়ে ! আজ এমন দেবদূতদের আমরা কি আর দেখা পাব ? কী করে পাব ? সে ঔরস কৈ ? কই সে গর্ভ ? সে যুগ আর কি ফিরে আসে না ? হয়ত না , আবার হয়ত আসে , তবে তার জন্য বহু সাধনা ও আরাধনার যে আগে দরকার। তা কি আমাদের আছে ? এতক্ষণ আমরা গ্রহ - নক্ষত্ৰভরা আকাশ দেখে আসছি , এবার দেখা “ আকাশভরা সূর্যতারা হ্যাঁ , সেই সূর্যতরর কথা , আর তার আকাশের কথা বলে এ প্রসঙ্গের যবনিকা টানি। সে সূর্য হুগলী জেলার ময়াল নিবাসী শিক্ষাগুরু প্রয়াত পার্বতী চরণ মণ্ডল মহাশয়। সত্যিই , প্রখর সূর্যের লেলিহান দীপশিখা যেন তার শিক্ষাদানে জ্বল জ্বল করে জ্বলত। কী যে গভীর ইংরাজী জ্ঞান ছিল , তা যে তার কাছে প্রত্যক্ষ শিক্ষা লাভ করেছে , সে - ই শুধু জেনেছে । আমার সহপাঠী বন্ধু ৷ রতনচন্দ্র সামন্ত ( বর্তমানে ঐ বিদ্যালয়েরই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষক ) হয়ত ঐ একই কথা বলবে । পেশাগত দিকে তিনি ছিলেন আইন বিদ । কিন্তু পশার না জমায় তিনি শিক্ষকতায় আসেন । সেই সঙ্গে শিক্ষাজগতও এই প্রকৃত গুণীকে পেয়ে ধন্য হ'ল । ইংরাজী ব্যাকরণ , অনুবাদ ও সাহিত্য কেমন করে রপ্ত করতে হয় , তা ' এর পদপ্রান্তে বসে শিক্ষা করে জীবনকে ধন্য করেছি । জীবনে আর ঘুরে তাকাতে হয়নি । কেমন করে ১ লাইন ইংরাজী লিখতে হয় , তা ' ! ইনিই হাত ধরে শিখিয়ে গেছেন , ঠিক যেমন বাংলায় আমার মাষ্টার কাকাবাবু ’ ‘ সাহিত্য করার বুনেদটি তৈরী করে দিয়ে আমায় চির ঋণী করে গেলেন জীবন ভাের । সেই কিশাের মন থেকে আজকের এই বৃদ্ধ মন কিছু লেখা , কিছু চর্চা করার আগে এদের চরণেই পূজা দিয়ে বসে , স্মরণ করে , কৃতজ্ঞতার ভার মাথাটা লুটিয়ে দেয় এদেরই চরণতলে । ধন্য তাই আমি , ধন্য জীবন আমার ।

‘ আকাশ ’ ‘ মহাকাশ ' তথা ' লক্ষীনারায়ণ ও ' ঈশ্বরচন্দ্র, ’ও ‘ শান্তিনিকেতন ‘ বিজয়তুর্য , ও ' রণভেরী ’ তথা ‘ সুবলচন্দ্র ও ‘ পার্বতীচরণ ।
‘আকাশ ’ - এর কথা বলেছি । হ্যাঁ , এইসব গ্রহ - নক্ষত্র - তারাকে ধরে রাখার মত এক মস্ত আকাশ ছিল , ছিল তার চেয়েও বড় ‘ মহাকাশ। ‘ আকাশ ’ যদি “ মহাকাশ ’ - এর পিতৃদেব চিরস্মরণীয় স্বৰ্গতঃ লক্ষ্ম নারায়ণ সামন্ত হন তবে ‘ মহাকাশ। ছিলেন তদায়পুত্র মনসুকার বরেণ্য সন্তান , প্রাক্তন জমিদার তথা এ বিদ্যালয়ের প্রাণ - প্রমি পুরুষ প্রয়াত ঈশ্বরচন্দ্র সামন্ত মহােদয় , ঠিক যেমন , বীরভূমের বােলপুর - ভূবন ডাঙ্গার ‘ বেহ্মডাঙ্গায় প্রথম অহল্যা উদ্ধারে এসেছিলেন একদিন রবি পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় , আর তার পরেই ঐ বেহ্মডাঙ্গার সমস্ত আকাশকে আলোয় উদ্ভাসিত করে তাকে ‘ মানুষ - রবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজকের কবিতীৰ্থ বা রবিতীর্থ ‘ শান্তি নিকেতন ’ - এ রূপ দিয়ে গেলেন । এখানেও , এই মনসুকায় এই আলোর দিশারী ‘ ঈশ্বরচন্দ্র এর হাতে ছিল দু ’ টি প্রজ্বলন্ত দীপশিখা - এক হাতে বিজয়তূর্য ‘ সুবল চন্দ্র , অন্য হাতে রণভেরী 'পার্বতীচরণ' । এই বৈয়ী বা ত্রিশক্তির মিলিত তুর্যানাদে সেই চল্লিশের দশকের শেষপাদে এই বিদ্যালয় এ অঞ্চলের মধ্যমণি ছিল । ইড়পালা বীরসিংহ - ঘাটাল বিদ্যালয়ের পরেই যার স্থান ছিল বাঁধা ।

অর্ধশতকেরও পরে সে মনসুকা বিদ্যালয় আজও আছে সগর্বে মাথা উচু করে দাড়িয়ে , পেয়েছে তার দৃঢ় ভিত্তি , সরকারী পৃষ্ঠপােষকতায়। ক্রমসমৃদ্ধির যাত্রা তার আছে অব্যাহত। তাই , অযােধ্যা ঠিকই আছে , আছে সরযুও , নেই শুধু দশরথ , আর দাশরথি রাম । রামের বংশধর আছে । কিন্তু রাম তাে নেই । রাম যখন ছিলেন , তখন ‘ রাজসূয় যজ্ঞও হ ’ ত ফি বছরে আমরা তাকে ‘ আনন্দ যজ্ঞ ’ বলতাম । নাম ছিল তার স্মৃতি বার্ষিকী ’ অযােধ্যার ( মনসুকা ) রাম ( ঈশ্বরচন্দ্র ) এই আনন্দ যজ্ঞটি ( স্মৃতিবার্ষিকী উৎসব ) অতি নিষ্ঠাভরেই করতেন ও যজ্ঞশেষে পূর্ণাহুতি দিতেন , ঠিক যেমন পিতৃ আদেশ পালন করেন রামচন্দ্র বা ভ্রাতৃ - আদেশ পালনে রত হন ভরত । আর এখানে এই কবিতীর্থেও আর এক রাম অথাৎ রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতার মনের ইচ্ছার রূপ দিতে ‘ শান্তিনিকেতন ’ বানিয়ে গেলেন , প্রতি বছর পিতার দীক্ষান্ত দিনটিকে জনমনে জাগিয়ে রাখতে অদূরে কেঁদুলীর ‘ জয়দেব মেলা এর আদলে ‘ পৌষমেলা ’ - এর সৃষ্টি করে গেলেন । শান্তিনিকেতন থেকে মনসুকা অনেক দূরের । পথ চারটি জেলার ব্যবধান , কিন্তু এ দুই জায়গার দুই রাম , অথাৎ স্রষ্টাদ্বয়ের সৃষ্টির আদর্শ যেন একই হারে , একই ভারে হয়েছে গ্রথিত । দু ' জনেই নিজ নিজ সৃষ্টিকে রূপ দিতে গিয়ে নিজ নিজ সম্পত্তি , জমিদারী , ইত্যাদিকে উৎসর্গ করেছেন তাঁদের সৃষ্ট মানসকন্যাদ্বয়ের কল্যাণে — লালন - পালনে । অনেক প্রতিষ্ঠানের গোড়ার ইতিহাসও এই রকম অনেক মহাপ্রাণের নিঃস্বার্থ ত্যাগে , দানে ও সেবায় হয়েছে লেখা । আমার দ্বিতীয় তথা শেষ বিদ্যালয়ে জীবন কাটে ক্ষীরপাই বিদ্যালয়ে , তা আগেই বলেছি সেটিরও প্রাথমিক গঠণকালের রূপকার ছিলেন অগ্রজ । প্রয়াত বৈদ্যনাথ রায় মহাশয় । কী কষ্টেই না তিনি একদিন বিদ্যালয়টিকে চালাতে চেষ্টা পেয়েছেন সেদিন । লটারী পর্যন্ত করেছেন বারবার । হে ঈশ্বর , ওগাে ভগবান ! এমন মহাপ্রাণদের তুমি বেশী করে পাঠাও না কেন । তোমার এই অভাগা মর্ত্যধামে ? তাহলে তাে অনেক ভাল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারত । এবার সেই সে আনন্দযজ্ঞের কথায় আসি ।

২) স্মৃতিবার্ষিকী উৎসব : --

সম্ভবতঃ পিতৃদেবের জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী বা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী - দিবস হিসাবেই পালিত হ ’ ত দিনটি । ঠিক ইতিহাস জানা নেই । সে দিনটিতে দেখতাম , ‘ ঈশ্বর ’ যেন সত্যিই ঈশ্বর হয়েছেন । একইসঙ্গে কর্তব্যের টানে ধ্যানমগ্ন , অথচ সদাচঞ্চল । আবার যেন ব্রতধারীও উৎসব শেষে সমূহ ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকমণ্ডলীর তার গৃহে অন্নগ্রহণের থাকত নিমন্ত্রণ — প্রাণের নিমন্ত্রণ । যতক্ষণ না সবার ভােজন - পর্ব নির্বিঘ্নে সমাধা হচ্ছে , ততক্ষণ তিনি যেন "কোন আলোকে মঙ্গলালোকে" থাকতেন ধ্যানমগ্ন অচঞ্চল ও উদ্বিগ্নমনা । এই প্রাণপুরুষের পুরা কর্মপ্রণালী টাই যেন জীবনের এক বড় শিক্ষা । সেই ঋষিতুল্য মানুষটিকে আজ অন্তরের অযুত প্রণাম । জানিয়ে যাই । এই স্মৃতিবার্ষিকী উৎসব ছিল । বহুদিকে বিস্তৃত ও আবৃত্তি , নাটিকা , ক্রীড়া প্রদর্শন , সঙ্গীত , পুরস্কার বিতরণ , বক্তৃতা ও শেষে জমিদার বাড়ীতে ভােজনপর্বানুষ্ঠান । ফুল , মালা , পতাকা নিয়ে দলে দলে আমরা হাজির হতাম ঐ মধুর স্মৃতি - দিয়ে ঘেরা দিনটিতে । সম্ভবতঃ গ্রীষ্মের এক তাপদগ্ধ দিনেই এই মহােৎসব হত । প্রায় এক / দেড়মাস আগে থেকেই চলত নানান । বিষয়ের মহড়া । ইংরাজীতে আবৃত্তি করা ছিল আমার নির্ধারিত বিষয় । এ বিষয়ে আমার প্রথম নির্দেশক ছিলেন প্রয়াত রামপদ পােড়ে মহাশয় ও তৎসহ প্রয়াত মহেন্দ্রবাবু ও পার্বতচরণ মণ্ডল মহােদয়দ্বয় – একথা আগেই বলেছি । পুরস্কারই যে কত পেতাম , তার লেখাজোখা নেই – উচ্চতর শ্রেণীতে উচ্চস্থান অধিকারে , আবৃত্তিতে , ইংরাজী হাতের লেখায় , পরীক্ষায় ইংরাজীতে বেশী নাম্বার পাওয়া , ইত্যাদিতে । এমন একটি সুমধুর উৎসব ছাত্রছাত্রীদের জীবনে । কী যে দারুণ প্রভাব বিস্তার করে , তা ভুক্ত ভােগীরা নিশ্চয়ই বােঝেন ।

জীবন - সায়াহ্নে এনে জীবনদেবতা আমার কাছে তার ঋণশোধ করতে মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর সাধনার সুযােগ দেন । ১৯৯০ সাল সেই প্রথম সেখানে বিদ্যাসাগরের মৃত্যুবার্ষিকী অনুষ্ঠান পালনের সুচনা করলাম ভাষণও দিলাম সে ভাষণে বাল্যের কৈশােরের এই স্মৃতিবার্ষিক টির পুরাে চিত্রটি তুলে ধরি ও সেই সঙ্গে বীরসিংহ বিদ্যালয়ের স্মৃতি বার্ষিকীর কথাও । ভাষণটি ১৯৯১ সালের ‘ বন্দনা ’ ও ‘ তরুণবার্তায় প্রকাশ পেয়েছে ।

৩ ) কথাশেষ :-

এতক্ষণ ধরে আমার সুধী পাঠক - পাঠিকাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়েছি বলে আমার অনিচ্ছাকৃত অপরাধ স্বীকার করছি । তবে এর পেছনে আমার লক্ষ্য শুধু একটাই — তা ’  হ'ল আমার অগণিত উত্তরসুরি ছাত্রছাত্রী আমার এ অতীত চারণায় হয়ত উপকৃত হবে , আগামীর আনন্দ সন্ধানে রত হবে । অনেকদিন ধরে তাদের মন রাঙিয়ে উঠতে থাকবে , গুনগুনিয়ে গান গেয়ে উঠবে তাদের মন , কণ্ঠ , কারণ এ যে তাদের নিজের জিনিষ , মাটির জিনিষ । আর সেইখানেই মাের জয় , আমার অনেক পাওয়া । আমি কবি নই , নই সাহিত্যিকও । অনাড়ী ও অপরিপক্ক হতে কখনাে - সখনাে কিছু লেখার চর্চা করে থাকি মাত্র । এও হয়ত এই কবিতীর্থের পুন্য মাটিরদানে ঠিক জানিনে ।

এবার কথা করি শেষ । শেষের বেলায় আমার বেলা শেষের গান গেয়ে যাই চলে -
হে নূতন , হে নবীন ,
আত্মার আত্মীয় ,
ওগাে উত্তরসূরি ?
তােমারে জানাই ,
মােরা যেন চিরকাল ,
সমস্বরে গান গেয়ে যাই :
“ যাবার বেলায়
এই কথাটি
জানিয়ে যেন যাই ,
যা পেয়েছি , যা নিয়েছি ,
তুলনা তার নাই । ”

Shyamal Kumar Rong

আমি মনসুকা খবরের সাংবাদিক। খবর, ভিডিও, তথ্য, গল্প পাঠাতে যোগাযোগ করুন। ফোন/হোয়াটসঅ্যাপ ৯৭৭৫৭৩২৫২৫.

নবীনতর পূর্বতন

Mansuka Khabar

Mansuka khabar
Mansuka khabar