শ্যামল রং, মনসুকা, ২০ আগস্ট: মনসুকা লক্ষ্মীনারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব, বনমালী ঘোড়া মহাশয় (বয়স ৮১), ১৮ই আগষ্ট রবিবার রাত্রে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে বিদ্যালয়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে এবং বৃহত্তর এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁর কড়া শাসন এবং শিক্ষার প্রতি অদম্য নিষ্ঠা এখনও মনসুকা এলাকার মানুষদের হৃদয়ে অম্লান হয়ে রয়েছে।
বনমালী ঘোড়া মহাশয় ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯৮২ সালে মনসুকা লক্ষ্মীনারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং ১লা নভেম্বর, ২০০৩ সালে অবসর নেন। আদি বাড়ি হুগলী ঘোড়াদহ গ্রামে । পরে তিনি ঘাটালের বাসিন্দা হন । ২১ বছরের কর্মজীবন শুধু মনসুকা বিদ্যালয়ের নয়, সমগ্র এলাকার শিক্ষাক্ষেত্রের মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কঠোর শৃঙ্খলা এবং নিয়মানুবর্তিতায় বিশ্বাসী বনমালী বাবুর নির্দেশনায় বিদ্যালয়টি শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশিষ্টতা অর্জন করেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষার মূল ভিত্তি হলো শৃঙ্খলা এবং এটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি কখনোই আপস করেননি।
বনমালী বাবুর শাসনকালকে স্মরণ করে অনেকেই বলেন, “তাঁর সময় কোনও শিক্ষার্থীই বিদ্যালয়ে সময়মতো উপস্থিত না হয়ে পার পেত না। তিনি শুধু ক্লাসরুমেই নয়, মাঠে, বারান্দায়, এমনকি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের প্রতিটি কোণে নজর রাখতেন, যেন ছাত্রদের আচরণ ও মনোভাব সবসময় সঠিক পথে থাকে।”
বনমালী ঘোড়া মহাশয়ের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, তিনি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রতি সমানভাবে দৃষ্টি রাখতেন। তাঁর কাছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনও পার্থক্য ছিল না—ধনী, গরীব, মেধাবী কিংবা পিছিয়ে পড়া—সবাই তাঁর কাছে সমান। তিনি কঠোর হলেও তাঁর কঠোরতার ভিতরে ছিল স্নেহ এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি গভীর ভালোবাসা। শিক্ষার্থীদের সুশৃঙ্খল এবং নৈতিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। কঠোর শাসনের মাধ্যমে তিনি শিক্ষার্থীদের জীবনে দৃঢ়তা আনতে চেয়েছিলেন এবং তাদের ভবিষ্যতের সাফল্যের পথ সুগম করতে চেয়েছিলেন।
তাঁর ছাত্রদের মধ্যে আজ অনেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তাঁরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন যে, বনমালী বাবুর শাসন এবং শিক্ষার প্রতি তাঁর দৃঢ় অবস্থান তাঁদের জীবনে সঠিক পথ বেছে নিতে সহায়ক হয়েছে। একজন প্রাক্তন ছাত্র আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, “বনমালী স্যার আমাদের শুধু ভালো ছাত্র নয়, ভালো মানুষ হতে শিখিয়েছেন। তাঁর শাসন আমাদের জীবনের ভিত্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।”
শিক্ষকতার পাশাপাশি বনমালী ঘোড়া মহাশয় বিদ্যালয় এবং আশেপাশের এলাকার উন্নয়নেও অবদান রেখেছিলেন। তিনি বিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তাঁর সময়ে বিদ্যালয়ে নজরুল মঞ্চ, গ্রন্থাগার এবং খেলার মাঠের প্রাচীর স্কুলের পরিকাঠামো উন্নতি হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বনমালী বাবু শুধু শিক্ষার্থীদের শিক্ষকের ভূমিকায় নয়, এলাকাবাসীর পরামর্শদাতার ভূমিকায়ও ছিলেন। তাঁর কাছে শুধু বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নয়, এলাকার সাধারণ মানুষও নানা বিষয়ে পরামর্শ নিতে আসতেন। সমাজের যেকোনও সমস্যা সমাধানে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসতেন। এলাকাবাসীরা তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন, “আমরা একজন শিক্ষাগুরুকে হারালাম, যিনি আমাদের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন।”
বনমালী ঘোড়া মহাশয় অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। পরিবারে স্ত্রী, দুই ছেলে এবং এক মেয়ে রয়েছেন। তাঁর পরিবারে শাসন এবং শৃঙ্খলার গুরুত্ব তিনি যেমন বুঝিয়েছেন, তেমনি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদেরও সেভাবে পরিচালিত করেছেন। তিনি নিজে ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ সমাজসেবক এবং সাধারণ জীবনযাপনের উদাহরণ।
বনমালী ঘোড়া মহাশয়ের অন্তিম যাত্রায় বিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, সহকর্মী, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং সাধারণ মানুষ সবাই উপস্থিত ছিলেন।
বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত কুমার পাল মহাশয় বলেন, “বনমালী বাবুর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর মতো একজন আদর্শ প্রধান শিক্ষকের উপস্থিতি আমাদের বিদ্যালয়ের ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি আমাদের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।”
তাঁর পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন হয় ঘাটালের ডোঙাঘাট শ্মশানে। তাঁর শেষ যাত্রায় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় এবং তাঁর আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই তাঁর রেখে যাওয়া শিক্ষার আলোকে নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করার সংকল্প গ্রহণ করে।
মনসুকা লক্ষ্মীনারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ে আজ ২০আগষ্ট প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক বনমালী ঘোড়া মহাশয়ের স্মরণে একটি বিশেষ সভার আয়োজন করা হয়। সদ্যপ্রয়াত এই কড়া শাসনে বিশ্বাসী শিক্ষককে শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত ছিলেন বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, এবং বিশিষ্ট প্রাক্তন ছাত্ররা।
স্মরণসভায় সবাই মিলে বনমালী বাবুর শিক্ষা, শৃঙ্খলা, এবং আদর্শকে স্মরণ করেন তাঁদের জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন। সভাটি যেন ছিল এক আবেগঘন পরিবেশে তাঁর স্মৃতিচারণের মিলনমেলা।
বনমালী ঘোড়া মহাশয়ের স্মৃতি এবং শিক্ষাদান এলাকার মানুষের হৃদয়ে চিরকালীন হয়ে থাকবে। তিনি ছিলেন এমন একজন শিক্ষক, যিনি শুধু শিক্ষার্থীদের বইয়ের শিক্ষায় সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং তাদের জীবনের প্রকৃত শিক্ষার পথে পরিচালিত করেছিলেন। তাঁর কড়া শাসনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা এবং তাঁর শিক্ষাদানের মূলমন্ত্র আজও বহু প্রাক্তন শিক্ষার্থীর জীবনে দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করছে।